৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:১১

মোবাইল ফোনের শোচনীয় সেবা

গতকাল সোমবার দুপুর ১টা। রাজধানীর ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ১১/এ সড়কের ৯৬ নম্বর বাড়ির ভবনের নিচতলায় দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। কয়েকবার চেষ্টা করেও সংযোগ মিলল না। তখন ওই ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী বলে ওঠেন, ‘স্যার, এখানে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করে না, এয়ারটেলে কিছুটা করে। তবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চেষ্টা করলে সমস্যা কিছুটা কম হতে পারে।’ প্রায় একই সমস্যার কথা জানালেন লালবাগ থানার ৬৩/এ পিলখানা রোডের এক বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে আমাকে তিনটি অপারেটরের সেবা নিতে হচ্ছে। সব জায়গায় সব অপারেটরের নেটওয়ার্ক কাজ করছে না।’ ঢাকার বাইরে গ্রাম এলাকার অবস্থা আরো খারাপ। মেহেরপুর সদর উপজেলার আশরাফপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেকের অভিযোগ, সেখানে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক ছাড়া অন্য মোবাইল ফোন অপারেটরের নেটওয়ার্ক তেমন কাজ করে না; গ্রামীণফোনও ঘরে চলে না; বাইরে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়।

ভুক্তভোগীরা আরো বলছে, সরকার মোবাইল ফোন সেবা নিয়ে যে সিদ্ধান্তই নেয় তা অপারেটরদের পক্ষে যায়। আগে অন্তত একই অপারেটরে কথা বলা যেত সাশ্রয়ী ব্যয়ে। গত বছর ১৪ আগস্ট অননেট-অফনেট সুবিধা তুলে দিয়ে যেকোনো নেটওয়ার্কে সর্বনিম্ন ৪৫ পয়সা মিনিট রেট ধার্য করা হয়। এতে গ্রাহকদের ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। মোবাইল ইন্টারনেটের অবস্থা আরো শোচনীয়। দেশে থ্রিজি সেবার পর ফোরজি চালু হয়েছে। কিন্তু এর প্রত্যাশিত সুফল গ্রাহকরা ভোগ করতে পারছে না। মোবাইল ইন্টারনেটের গতি যেমন, দামও বেশি। প্যাকেজ ও বান্ডেল অফার এবং পে পার ইউজ নামে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেকেই ওয়াইফাই সেবার দিকে ঝুঁকছে।

ফোরজি সেবা চালুর আগে প্রথমে বলা হয়, ইন্টারনেটে ১ জিবিপিএস গতি মিলবে। পরে বলা হয়, সর্বনিম্ন ২০ এমবিপিএস গতি পাওয়া যাবে। কিন্তু বিটিআরসির গত ১১ নভেম্বর জারি করা প্রবিধানে থ্রিজির গতি নির্ধারণ করা হয় ডাউনলিংকে ২ এমবিপিএস, আপলিংকে ১২৮ কেবিপিএস। ফোরজির গতি নির্ধারণ করা হয় ডাউনলিংকে ৭ এমবিপিএস ও আপলিংকে ১ এমবিপিএস। ভুক্তভোগীরা বলছে, ফোরজি সেবার ডাউনলিংকে এখন গড়ে ৪ এমবিপিএস গতিও পাওয়া যাচ্ছে না।

এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি টেলিকম রিপোর্টারদের সংগঠন টিআরএনবির সঙ্গে এক আলোচনাসভায় বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেছিলেন, অপারেটরদের সেবার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মান বেঁধে দেবে কমিশন। তা পূরণ করতে না পারলে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটরকে বলা হবে, আপনারা এ এলাকায় সার্ভিস দিতে পারবেন না, এখন থেকে আর গ্রাহক বাড়াতে পারবেন না, আপনারা এ মানের ওপরে বা নিচে অপারেট করতে পারবেন না—এসব বলা হতে পারে।’ সেদিন বিটিআরসি আরো বলে, মোবাইল ফোন অপারেটরদের সেবার মান ঢাকায়ও ভালো নয়। সভায় ছোট ছোট বিভিন্ন প্যাকেজ অফারে গ্রাহকদের সঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটরদের একধরনের প্রতারণা বন্ধের বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক জানান, মোবাইল ইন্টারনেটে সাত দিনের নিচে ডাটা প্যাকেজ বন্ধ করা হচ্ছে। ১ ফেব্রুয়ারির পর এ নির্দেশনা কার্যকর করা হবে। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি বিটিআরসি এক নির্দেশনায় মোবাইল ফোন অপারেটরদের জানায়, মোবাইল ফোনের সব ধরনের প্যাকেজ, বান্ডেল বা অফারের মেয়াদ হবে ন্যূনতম তিন দিন। এটা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রযোজ্য হবে এবং ৩০ দিন পর নির্দেশনাটি পর্যালোচনা করা হবে। কিন্তু তা আজও হয়নি বলে জানা যায়।

সেবার মান ঠিক করার জন্য কবে নাগাদ নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, এ প্রশ্নে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজুর রহমান সিদ্দিকী গত রবিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন বিভাগ কাজ করছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিটিআরসি এ ধরনের নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে খবর পেয়ে মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে জানিয়েছে যে কোনো নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। তারা নিজেদের উদ্যোগেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোবাইল ফোন অপারেটরদের সেবার মান অত্যন্ত খারাপ। গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছে আর পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফোরজি সেবা চালু হওয়ার পর ইন্টারনেটের যে গতি পাওয়ার কথা ছিল, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগও পাচ্ছি না। বড় শহরগুলোতেই এই অবস্থা। প্রান্তিক পর্যায়ে অবস্থা আরো শোচনীয়।’

মোবাইল ফোনের মানসম্মত সেবা নিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি অসন্তোষ ব্যক্ত করে এলেও ব্যবস্থা গ্রহণে তারা পিছিয়ে। এ বিষয়ে বিটিআরসির কমিশনার (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন) মো. রেজাউল কাদেরের বক্তব্য হচ্ছে, মোবাইল ফোন অপারেটরদের সেবার মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তিনি রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ নিয়ে একটি ড্রাইভ টেস্ট বা জরিপ শুরু হয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে এ জরিপ সম্পন্ন হওয়ার পর এখন খুলনায় চলছে। এ মাসেই এর একটা ফলাফল আপনারা জানতে পারবেন।’ কাদের মাধ্যমে এই জরিপ হচ্ছে, এ প্রশ্নে রেজাউল কাদের বলেন, ‘আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আমরাই এটা করছি।’

গত বছর ২৩ অক্টোবর বিটিআরসির ২১৯তম সভার কার্যপত্রে বলা হয়, কিউওএস মনিটরিং টুল দিয়ে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় জরিপ চালানো হয়েছে। যেসব স্থানে মোবাইল ফোন অপারেটরদের দুর্বল নেটওয়ার্ক পাওয়া গেছে সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ১২ নভেম্বর বিটিআরসির ২২০তম সভায়ও অপারেটরদের সেবার মান নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে সব জায়গায় মানসম্মত সেবা দিতে না পারার কারণ হিসেবে মোবাইল ফোন অপারেটররা এখন নতুন তথ্য জানাচ্ছে। গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর এক হোটেলে একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রধান নির্বাহী টেলিকম খাতের সাংবাদিকদের বলেন, যত্রতত্র জ্যামার বসানো হচ্ছে, এ জন্যই কলড্রপ বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘জ্যামার আমদানির আগে বিটিআরসির অনুমতিও নেওয়া হচ্ছে না। ঢাকায় শাহাবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বায়তুল মোকাররম এলাকা, বনানী, র‌্যাডিসন হোটেল—এসব এলাকায় জ্যামারের কারণে নেটওয়ার্কের মান উন্নত করতে পারছি না।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/02/05/733851