৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:০৯

প্রাথমিকের পাঠ্য বই মুদ্রণ

শতকোটি টাকা গচ্চা দিয়েও বিদেশিদের কাজের সুযোগ

বছরের প্রথম দিনে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনা মূল্যে প্রায় ৩৫ কোটি বই তুলে দেওয়া সারা বিশ্বের বিস্ময় এবং শিক্ষা খাতে আওয়ামী লীগ সরকারের বড় সাফল্য। সরকারের এই সাফল্যের অংশীদার দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ শতভাগ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিনা মূল্যের বই মুদ্রণে তাদের সুযোগ কমছে। প্রাথমিক স্তরের ২০২০ শিক্ষাবর্ষের বই মুদ্রণের জন্য শতকোটি টাকা গচ্চা দিয়েও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ রাখছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এতে দেশের টাকা চলে যাবে বিদেশে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশি শিল্প।

এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, এত দিন প্রাথমিকের বিনা মূল্যের বই মুদ্রণের মোট ব্যয়ের ৯ শতাংশ অর্থ দিত বিশ্বব্যাংক। আর সেই অর্থ পাওয়ার শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করা হতো। এতে কাজ পাওয়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে দরপত্রের দরের চেয়েও ৩১ শতাংশ বেশি টাকা খরচ করতে হতো। তবে এত দিন বলা হয়েছিল, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার পর কাজ করা হবে সম্পূর্ণ স্থানীয় দরপত্রে। অথচ ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের বই অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিকের বই মুদ্রণে বন্ধ হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন। কিন্তু এখনো বন্ধ হয়নি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশি কাগজ ও মুদ্রণশিল্প যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে বই ছাপানোর প্রয়োজন আমি দেখি না। তবে যেহেতু এত দিন আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কাজ হয়েছে, তাই সব কিছু আপগ্রেড হতে কিছুটা সময় লাগবে। প্রয়োজনে আমি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।’

জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন কাগজের মিল বর্তমানে মানসম্পন্ন কাগজ উৎপাদন করছে। এমনকি ওই সব কাগজ বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই শতাধিক ওয়েব মেশিন (উন্নত মানের চাররঙা বই ছাপার ডিজিটাল মেশিন) আছে। ওই সব যন্ত্রের মাধ্যমে মাত্র তিন মাসেই ৩৫ কোটি বই ছাপানো সম্ভব। ফলে সার্বিকভাবে কাগজ ও মুদ্রণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক দরপত্রে বই ছাপা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের ১০ কোটিরও বেশি বই মুদ্রণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৭৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকার বইয়ের কাজ করেছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। গত বছর দেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো গড় দর দিয়েছিল প্রতি ফর্মা দুই টাকা ৮৯ পয়সা। সেখান থেকে তাদের ৭ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়েছে। অর্থাৎ তাদের দর পড়েছে দুই টাকা ৬৮ পয়সা। আর বিদেশি মুদ্রাকররা গড় দর দিয়েছিল দুই টাকা ৬২ পয়সা। এই দরের সঙ্গে এনসিটিবিকে এলসি খরচ, ব্যাংক কমিশন, বেনাপোলে বই ছাড় করানোর ট্যাক্স, লেভি, ভ্যাট ও ইনস্যুরেন্স বাবদ ব্যয় করতে হয়েছে আরো ৩১ শতাংশ অর্থ। ফলে সব মিলিয়ে তাদের ফর্মাপ্রতি দর পড়েছে তিন টাকা ৪৩ পয়সা।

যদিও আন্তর্জাতিক দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী ১৫ শতাংশ কম দরে দেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার কথা। তবে সেখান থেকে তাদের মোট মূল্যের ওপর ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ফলে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮ শতাংশ কম দরে কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হচ্ছে মোট কাজের মূল্যের ওপর অতিরিক্ত ৩১ শতাংশ প্রণোদনা। সে হিসাবে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রণোদনার সঙ্গে তুলনা করলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ২৩ শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা পাচ্ছে। ফলে আগামী দিনে প্রাথমিকের পাঠ্য বই মুদ্রণে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রাথমিকের বই মুদ্রণে সরকারকে শতকোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করার আগেই এলসির মাধ্যমে টাকা পেয়ে যায়। কিন্তু দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা দেওয়া হয় কাজ শেষ করারও কয়েক মাস পর।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে বিশ্বব্যাংক প্রকিউরমেন্টে হস্তক্ষেপ করত, কিন্তু গত বছর থেকে আর করছে না। প্রাথমিকের বই মুদ্রণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে, আমরা সেভাবেই কাজ করব।’

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাথমিকের বইয়ে এখন আর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নেই। ফলে আন্তর্জাতিক দরপত্রের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর বাংলাদেশ কাগজ ও মুদ্রণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে আমরা কোনোভাবেই মনে করি না, আন্তর্জাতিক দরপত্রের আর প্রয়োজন আছে। আমরা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করেছি। আশা করছি, সরকার চলতি বছর অর্থাৎ ২০২০ শিক্ষাবর্ষ থেকেই আমাদের দাবি মেনে নেবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ করে দেওয়ার পেছনে রয়েছে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের একটি অংশ। কারণ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করলেও তাদের স্থানীয় এজেন্ট লাগে। ওই এজেন্টদের সঙ্গে এনসিটিবির কয়েকজন কর্মকর্তার কমিশন বাণিজ্য রয়েছে। এ ছাড়া যে দেশে মুদ্রণকাজ হয় সেই দেশে এনসিটিবির নিজস্ব অর্থায়নে একাধিকবার ভ্রমণ করার সুযোগ থাকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। বিদেশে থাকাকালে তাঁরা বড় অঙ্কের ভ্রমণ ভাতাও পান। ফলে মানের অজুহাত দেখিয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের একটি অংশ সব সময়ই আন্তর্জাতিক দরপত্রের পক্ষে থাকে।

জানা যায়, এত দিন যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের বই মুদ্রণের কাজ করেছে তাদের কেউই ঢাকা বা এর আশপাশে বইয়ের দরপত্রে অংশ নেয়নি। এর প্রধান কারণ হলো, এতে যথাসময়ে বই সরবরাহ করতে হবে। আর মানের দিকটাও ঠিক রাখতে হবে। আগে একাধিকবার বিদেশি প্রতিষ্ঠান শিপমেন্টসহ ট্রান্সপোর্ট জটিলতার কারণে সময়মতো বই সরবরাহ করতে পারেনি।

একাধিক মুদ্রাকর জানান, বাংলাদেশে জনগুরুত্বপূর্ণ যেসব শিল্প যেমন ওষুধ, খাদ্য ইত্যাদিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র হয়, সেখানে দেশি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ শতাংশ কম দরে কাজ পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ মুদ্রণশিল্পে মাত্র ১৫ শতাংশ কম দরে কাজ পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এখন যদি আন্তর্জাতিক দরপত্রেই কাজ করতে হয় তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ৩১ শতাংশ অতিরিক্ত অর্থও দরপত্রের মূল্যের সঙ্গে যোগ করতে হবে। অর্থাৎ সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/02/05/733853