৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৫:৪৪

স র জ মি ন: চিকিৎসা সেবায় সন্তুষ্ট কেউ কেউ

চিকিৎসক নেই, ফিরে গেলেন রোগী

পাবনার চাটমোহরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম। নসিমন উল্টে তার বাম পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। দুর্ঘটনার পর চার মাস চলে গেছে। কিন্তু ক্ষত শুকায়নি এখনো। ভাঙা স্থানে পচন ধরেছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাজশাহীর চিকিৎকরা জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এ রেফার করেন। গতকাল তাকে স্বজনরা হাসপাতালে নিয়ে এলেও চিকিৎসক দেখাতে পারেননি। সিনিয়র চিকিৎসকরা একটি সম্মেলনে থাকায় জাহাঙ্গীর চিকিৎসা নিতে পারেননি।

 পঙ্গু হাসপাতাল বলে পরিচিত নিটোর বহির্বিভাগের করিডোরে কথা হয় জাহাঙ্গীর আলমের বাবার সঙ্গে। তিনি বলেন, চার মাস আগে বাজার থেকে জাহাঙ্গীর গরু কিনে বাড়িতে ফিরছিলেন। পথে নসিমন উল্টে তার বাম পা ভেঙে যায়। ঘটনার পরপরই জাহাঙ্গীরকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে প্লাস্টার, পায়ে রড দিয়ে সেখানে চিকিৎসা নেন।

কাটা জায়গা পুরোপুরি না শুকালেও ডাক্তার রড খুলার জন্য বলেন। পরে রড খুললেও সার্জারির স্থান আর শুকায়নি। এমনকি হাড়ের ভাঙা স্থান জোড়া লাগেনি বলেও জানতে পেরেছেন। রাজশাহী থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের এক চিকিৎসকের রেফারেন্স দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জাহাঙ্গীরের বাবা যখন কথা বলতে ছিলেন তখন তার চোখে মুখে হতাশার ছাপ। কারণ বুধবার হাসপাতালে এসে তিনি ওই চিকিৎসককে পাননি। জাহাঙ্গীর তার পা দেখিয়ে বলেন ভাই আমার অবস্থা ভালো না একটু ব্যবস্থা করেন। ঢাকায় আমাদের তেমন কেউ নেই। জাহাঙ্গীরের বাবা জানান, রোববার রাতে ঢাকায় এসেছেন। এক আত্মীয়র বাসায় থেকে সকালেই হাসপাতালে এসেছেন।

দুপুর গড়িয়ে গেলেও ডাক্তার পাননি। পরে ডাক্তার দেখানোর জন্য বহির্বিভাগে গিয়েও কোনো কিছু করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে চলে যান।

গতকাল পঙ্গু হাসপাতালের পুরাতন একটি ভবনে এবং নতুন ভবনের বাইরে চলছিল বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির ‘বোসকন ২০১৯’ সম্মেলন ও যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী। এ কারণে চিকিৎসকদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। অনেক রোগী ট্রলিতে হাসপাতালের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন ডাক্তারের আসার অপেক্ষায়। ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকে আবার বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন, কেউ কেউ ভর্তি করেনি বলে। অনেকে আবার চিকিৎসা নিতে পেরেছেন। তাদের কেউ কেউ সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছেন।

পটুয়াখালী থেকে পঙ্গু হাসপাতালে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব মোজাম্মেল হোসেন। মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে ফেরার পথে পড়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙে গেছে। পটুয়াখালীতে ডাক্তার দেখালেও তারা ঢাকার এ হাসপাতালে রেফার করেন। পরে স্ত্রী তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগের করিডোরে মোজাম্মেলের সঙ্গে কথা হয়। তার স্ত্রী জানান, এত দূর থেকে তারা এসে ডাক্তার দেখালেও তাদের ভর্তি নেয়নি। বলে দিছে সিট খালি নেই। মঙ্গলবার আবার আসতে। তার পরও বিকাল তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে যান। হাসপাতালের তৃতীয় তলার পুরুষ বি-ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির মো. মোহন মিয়া। কুমিল্লায় এক মোটরসাইকেল দুর্ঘনায় তার বাম পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। ২৬ দিন ধরে শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে।

এখন পর্যন্ত ৬ বার গেছেন অপারেশন থিয়েটারে। কবে বাড়িতে যেতে পারবেন তা জানা নেই এ রোগীর। গতকাল দুপুরে মানবজমিন প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন মোহন মিয়ার চোখেমুখে দেখা যায় রাজ্যের হতাশার ছাপ। আবার কখনো আশার কথা শুনান। তিনি বলেন, হাসপাতলে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা পাচ্ছেন। তবে কিছু কিছু জিনিষের জন্য তাকে টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, যেটা হাসপাতালের দেয়ার কথা। এর বাইরে হাসপাতালের বয়দের কম বেশি টাকা দিতে হয়। তবে অপারেশনের জন্য এ পর্যন্ত কোনো টাকা তার লাগেনি তার। মোহন মিয়া জানান, তার পায়ে যে রড লাগানো হয়েছে তা তার কিনতে হয়েছে।

মো. রাজু। পেশায় রড মিস্ত্রি। বিল্ডিং থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গেছে। পুরুষ বি-ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজু। তার সঙ্গে যখন কথা হয় তখন রাজুর পা বেডের সঙ্গে বাঁধা। কোনোভাবে যেন না লড়তে পারে এজন্য টানটান করে বেঁধে রোখা হয়েছে। রাজু গত ২১শে জানুয়ারি থেকে এখানে ভর্তি রয়েছেন। তার পায়ের হাড় ভেঙে গেলেও অপারেশন করতে হবে কি না ডাক্তাররা এখনো জানাননি। এ কারণে তিনি বলতে পারেন না কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন। তিনি হাসপাতালে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, আমি যেদিন আসি নিচ থেকে এক দালাল ধরেছিল। কিন্তু তার অভিভাবকেরা কোনো খপ্পরে পড়েননি।

তবে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশংসা করলেন জন্ম প্রতিবন্ধী রাকিবের মা। তার ছেলের জন্ম থেকে দুই পায়ের পাতাই সোজা। ভাঁজ করতে পারতেন না। প্রথমে এক পা সার্জারির মাধ্যমে ভালো হয়েছে। এরপরে অন্য পা ও সার্জারি করিয়ে ডাক্তারা রড বসিয়ে দিয়েছেন। রাকিবের মা বলেন, গত তিন বছর ধরে আমরা এখানে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমার ছেলে এখন এক পায়ে জুতা পরতে পারে। হাঁটতেও পারে কিছুটা। অন্য পায়ের চিকিৎসা চলছে। ডাক্তাররা বলেছেন শিগগিরই রাকিব অন্য পায়েও হাঁটতে পারবেন। তিনি হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রশংসা করে বলেন, আমরা এখানে ভালো চিকিৎসা পেয়েছি। এখানের ডাক্তাররা অনেক আন্তরিক।

গতকাল পঙ্গু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড, জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা যায় হাসপাতালের পরিবেশ বিগত দিনের তুলনায় ভালো। রোগীদের যেমন গাদাগাদি নেই, তেমনি হাসপাতালের ওয়ার্ড, করিডোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়িও নেই। রোগীরাও অনেকটা সচেতন। তবে জরুরি বিভাগের ভেতরে কিছুটা জটলা দেখা যায়। যা দুপুর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=158044&cat=2