৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:১৪

সাত বছর ধরে প্রতিক্ষা ॥ ওরা ফিরে আসবে

২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। রাত সাড়ে বারোটা। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছুটছে হানিফ পরিবহনের ঝিনাইদহ-৩৭৫০ গাড়িটি। গাড়িতে অন্যযাত্রীদের মত ওয়ালিউল্লাহ এবং আল-মুকাদ্দাস নামের দুই যাত্রী। গন্তব্য যাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। গাড়ি তখন সাভারের নবীনগর। হঠাৎ গাড়িটি থেমে গেল। সামনে র‌্যাব-৪ এর কালো গাড়ি। র‌্যাবের পোষাক পরা ৮-১০ জন। সাথে সাদা পোষাকধারী কয়েকজন। হনহন করে সবাই গাড়িতে উঠলো। পরিচয়? আমরা আইনের লোক। আমাদের সাথে আসুন। সবার মাঝ থেকে দু’জনকে নিয়ে গেল। যাত্রীরা হতবাক, ভয়ে বিহ্বল। এদিকে বন্ধুরা অপেক্ষায়। কিন্তু ওয়ালিউল্লাহ কোথায়? কোথায় মুকাদ্দাস? রাত যে ফুরিয়ে গেল। আর কত দেরি? তবে কী ওরা অপহরণ! গুম! নাকি...? আজো প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর খুজে পায়নি কেউ।

খবর শুনে মায়ের চোখের পানি ঝরা শুরু হয়েছে। বাবার হৃদয়টা ছটফট করছে। ছোট ভাই-বোনেরা খুঁজছে তাদের শান্তি-আদর্শের আশ্রয়। ক্যাম্পাসের বন্ধুরা খুঁজছে তাদের প্রিয় বন্ধুটিকে। না নেই। কোন খোঁজ নেই বন্ধুদের। তারা তো বাড়িতে যায়নি। ফিরেনি ক্যাম্পাসে। শুরু হলো তাদের সন্ধান। কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজিপুর। না কোথাও নেই। আছে কোথায়? সাভারেই আছে। র‌্যাব ৪-এর কার্যালয়ে। গাড়ির যাত্রী আর সহকারীরা বলে উনারা ছিল র‌্যাব-৪ এর সদস্য। বাদ যায়নি আশেপাশের থানা গুলোও। চাওয়া একটাই আমার ছেলে কোথায়? কোথায় আমার ভাই-বন্ধু? জবাব নেই তাদের। প্রথমে স্বীকার করলেও পরে বলে আমরা তো জানি না। সাদাসিধে জবাব।

কোন উপায় নেই। শুরু হলো মায়ের কান্না। বাবার আহাজরি। ভাই-বন্ধুদের অপেক্ষা। এলাকাবাসীর জিজ্ঞাসা আর কত দিন? ইবি ক্যাম্পাস উত্তাল। চলছে মিছিল, মানববন্ধন। শ্রেণি কক্ষে তালা সবশেষে সড়ক অবরোধ। অংশ নিল হাজারো শিক্ষার্থী। আসলেন শিক্ষকরাও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিষ্ফল প্রচেষ্টা। কোন উপায় না হওয়ায় দুইজনের পরিবার গেলেন ঢাকায়। জাতীয় প্রেস-ক্লাবে করলেন সংবাদ সম্মেলন। প্রধানমন্ত্রী আর পুলিশের কাছে জানালেন আকূল আবেদন। আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন। ফিরিয়ে দিন আমার ভাইকে। সেখান থেকে নিয়ে আসলেন আশ্বাস। তারা বলেন ‘আমরা চেষ্টা করছি।’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর গুম হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আসল প্রেসবার্তা। হিউমান রাইটস ওয়াচসহ দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা জানালো জোর দাবি। তাদের উদ্ধারে সরকারকে জোর প্রচেষ্টা চালানোর আহবান করা হলো। লোক দেখানো প্রচেষ্টা করা হলো সরকারের পক্ষ। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো তাদের গুমের খবর।

হারিয়ে যাওয়া ওয়ালিউল্লাহ দাওয়া এন্ড ইসলামিক স্টাডিজের মার্স্টাসের ছাত্র। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পিরোজপুরের কমদতলী ইউনিয়নে খানাকুনিয়ারী গ্রামে জন্ম। মাওলানা আবদুল হালিমের বড় সন্তান। আর মুকাদ্দেস আল-ফিকহ্ বিভাগের ছাত্র। ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলার সোজালিয়া গ্রামের মাওলানা ফজলুর রহমানের ছেলে। মেধার স্বাক্ষর রেখে চলছিল বরাবর, বিশষত সাংস্কৃতিক জগতের আধারের আলো হয়ে। হারিয়ে যাওয়ার আগে লিখে গিয়েছেন শতাধিক গান, গল্প আর নাটক।

মা-বাবার দাবি ওরা আছে। প্রশাসনের কাছেই। সরকারের আশ্বাস পূরণ হয়নি সাত বছরেও। কিন্তু কেন? আজও তাদের ফিরিয়ে দিলোনা। ওরা আসবে। এক দিন, সপ্তাহ, মাস বা বছর পরে। মায়ের কথা আমার ছেলে বেঁচে আছে। বাংলার হাজারো ঘরে আমাদের ওয়ালি-মুকাদ্দাস বেঁচে আছে। ওরা আসবে বিজয়ীর বেশে।

আজও মায়ের সেই অবস্থার অবসান ঘটেনি। নাড়ী ছেড়া ধনকে কি ভুলে থাকা যায়? না, তা কখনোই নয়। চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও থামেনি কান্না। তাই তো আজও সন্তানের ফিরে পাবার আশায় অপেক্ষায় আছেন তারা। শুধুই অপেক্ষা।

ইবির নিখোঁজ মুকাদ্দেস ও ওয়ালিউল্লাহ