৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ১১:৫২

স র জ মি ন ঢা মে ক

মুমূর্ষু রোগী, চিকিৎসা শুরু হতেই সময় লাগলো দুই ঘণ্টা

শনিবার বেলা সাড়ে ১২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে ভেসে আসছিল কান্নার শব্দ। কাছে গিয়ে দেখা গেল মধ্যবয়সী একজন এম্বুলেন্সে বসে কাঁদছেন, সঙ্গে তার স্ত্রীও। কাদতে কাদতে মোবাইল ফোনে কাউকে বলছিলেন, আমার ছেলেটারে আর বাঁচাতে পারবো না। আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি একটা ট্রলি পাচ্ছি না। কখন ট্রলি পাবো আর কখন তার চিকিৎসা শুরু হবে। কথা বলতে বলতে তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন। পরে এক সাংবাদিকের সহযোগিতায় ট্রলির ব্যবস্থা হয়।

কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় নিউরো সার্জারি জরুরি বিভাগে। ভুক্তভোগী ওই বাবার নাম আবদুস সাত্তার আর অসুস্থ ওই রোগীর নাম তৌহিদ। ১০ বছর
বয়সী এই শিশুর মাথায় গাছের আঘাত লাগে। কুমিল্লার হোমনা থেকে গুরুতর অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হয় ঢামেকে।

তৌহিদের বাবা আবদুর সাত্তার মনে করেছিলেন জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে তার ছেলের চিকিৎসা শুরু হবে। কিন্তু না জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জরুরি ভিত্তিতে একটি সিটিস্ক্যান করতে দেন। স্লিপ নিয়ে জরুরি বিভাগের সিটিস্ক্যান রুমে গিয়ে জানা যায় দুপুর ২টার আগে সিটিস্ক্যান করা হবে না। মেডিকেল-২ থেকে করাতে হবে। মুমূর্ষু তৌহিদের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল।

একটি ট্রলি দিয়ে ফের তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মেডিকেল-২ সিটিস্ক্যান রুমের সামনে। কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে রিসিট জমা দিলে দেখা যায় সেখানে আরো ১০-১২ জন রোগী অপেক্ষা করছেন। তাদের অনেকেই আগে থেকে ভর্তি ছিলেন। উপায়ান্তর না পেয়ে তৌহিদের বাবা কাঠ মিস্ত্রি আবদুর সাত্তার উপস্থিত একজন সাংবাদিকের সহায়তায় কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে বেলা ১টা ৪০ মিনিটে ছেলের সিটিস্ক্যান করান। সিটিস্ক্যানের ফিল্ম নিয়ে ফের জরুরি বিভাগে এলে চিকিৎসকরা অবস্থা সুবিধাজনক না হওয়াতে দুপুর ২টার দিকে তাকে নিউরো সার্জারির ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করার সুপারিশ করেন। ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে সেবিকারা দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে তৌহিদকে গ্রহণ করেন। সেখানে পুনরায় ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে ২টা ৪০ মিনিটে তৌহিদকে স্যালাইন পুশ করেন। গুরুতর আহত এই রোগী ঢাকা মেডিকেলে আসার প্রায় দুই ঘণ্টা ১০ মিনিট পর প্রথম চিকিৎসা পায়। সরকারি চিকিৎসাসেবার জন্য দেশের সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠানে জরুরি সেবার এটাই চিত্র। এ অবস্থা শুধু শিশু তৌহিদের ক্ষেত্রে নয়। প্রতিদিনই এমন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে নিরীহ, গরিব সাধারণ রোগীদের।

গত ৬ই জানুয়ারি নতুন আঙ্গিকে ঢামেকের জরুরি বিভাগের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক। উদ্বোধনের দিন ঢামেক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, জরুরি বিভাগে ১৫ শয্যার একটি আধুনিক ও জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা কেন্দ্র নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। এখানে রাখা হয়েছে ৪টি আইসিইউ বেড, ৬টি এইচডিইউ বেড ও ৫টি অবজারভেশন বেড। এই কেন্দ্রটির নাম দেয়া হয়েছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টার। বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনাসহ আহত রোগীদের ক্যাজুয়ালটি চিকিৎসার জন্য ৫ শয্যবিশিষ্ট একটি ক্যাজুয়ালটি অবজারভেশন কক্ষ রয়েছে। যেখানে ইসিজি, নেবুলাইজেশন, কার্ডিয়াক মনিটরসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। গাইনি এন্ড অবস ও শিশু রোগীদের কনসালটেশন কক্ষ নতুনভাবে করা হয়েছে। নিউরো সার্জারি ও হেড ইনজুরিসহ বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল রোগীদের জন্য একটি জেনারেল সার্জারি ও নিউরো সার্জারি জরুরি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এখানে ৩টি শয্যাসহ একটি মাইনর ওটি রয়েছে।

কেমিক্যাল দূষণজনিত রোগীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য একটি ডিকন্টামিনেশন কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারে আগত রোগীদের দ্রুত রোগ নিরূপণের জন্য এই কমপ্লেক্সে ১২৮ স্লাইস সিটি স্ক্যান মেশিন নতুনভাবে স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া ডিজিটাল এক্সরে, আল্টাসনোগ্রাফিসহ একপি মিনি প্যাথলজি ল্যাবরেটরি নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে যেকোনো মুমূর্ষু রোগীর দ্রুত রোগ নিরূপণ করে চিকিৎসা দেয়া যাবে। কিন্তু তৌহিদের বেলায় এমনটি দেখা যায়নি। পুরাতন রীতিনীতি মেনেই তৌহিদকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।

জানতে চাইলে জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার জিল্লুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, জরুরি বিভাগের সিটিস্ক্যান রুম সার্বক্ষণিক খোলা রাখার কথা থাকলেও দুপুর ২টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। এ সময়টা মেডিকেল-২ এর জরুরি সিটিস্ক্যান খোলা রাখা হয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নতুন আঙ্গিকে জরুরি বিভাগ চালু করা হলেও এখনো সবকিছু চালু করা হয়নি। শুধুমাত্র উদ্বোধন করে রাখা হয়েছে।

শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে নিউরো সার্জারি ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের নার্সিং স্ট্রেশনের সামনে রোগীর ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন মধ্যবয়সী শাহিনা বেগম। কাছে যেতেই বললেন আপনি কি এখানকার। জবাবে না শুনে তিনি কিছুটা আশাহত হলেন। কাউকে খুঁজছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, নিউরো সার্জারি ইউনিট ৩ অধীনে ২১ নম্বর বেডে আমার ছেলে হানিফ চিকিৎসাধীন রয়েছে। মাথার যন্ত্রণা ও খিচুনির কারণে তাকে ৭ই জানুয়ারি ভর্তি করা হয়েছে। ছেলেকে ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। চিকিৎসক, নার্স কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না। শাহিনা বেগমের সঙ্গে আরো ১৫ মিনিট কথা বলার পর বিশ্রামাগার থেকে একজন ব্রাদার এসে হাজির হন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট পরে শাহিনা বেগম একজন ব্রাদারের দেখা পান।

নিউরো সার্জারি ইউনিট ২ অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন বরিশালের সোহাগ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে গত ১৩ই জানুয়ারি তাকে ভর্তি করা হয়েছে। সোহাগের শাশুড়ি রহিমা বেগম বলেন, পুরোপুরি ভালো হওয়ার আগেই আমাদের রোগীকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। মাথার আঘাত ভালো হয়েছে কিন্তু এখনো অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে। কথা বলতে পারে না নিজের হাতে খেতে পারে না। আমরা চাই আরো ক’দিন রেখে তাকে ভালোভাবে সুস্থ করে বাসায় নিয়ে যেতে। তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক নেই- যার কাছে গিয়ে পরামর্শ করে তাকে আরো কিছুদিন রাখা যাবে। যারা আছে তারা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না বলে জানিয়েছেন। রহিমা বলেন, শুক্রবার হলে কোনো চিকিৎসক আসেন না। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আছি কিন্তু কোনো ছুটির দিনে কেউ আসেন না। তাই রোগী নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। চিকিৎসকের পাশাপাশি সেবিকাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এতগুলো রোগী অথচ ১-২ জন সেবিকা ছুটির দিনে দায়িত্ব পালন করেন।

মেডিকেল-২ এর মেডিসিন ওয়ার্ড ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডের রোগী শিমুলিয়ার প্রভাষক এসএ হোসাইন বলেন, ছুটির দিনে কোনো চিকিৎসক আসেন না। সেবিকারা বসে বসে গল্প করেন। কোনো কাজে গেলে ধমক দিয়ে বলেন বেডে যান আসতেছি। ওষুধের দরকার হলে পাই না। ৮টার ওষুধ সকাল সাড়ে ১০টায় পাই। আয়া ভুয়ারা ঝাড়ি দেন। ওয়াশরুমে প্রবেশ করা কষ্টকর। ময়লা আবর্জনা দুর্গন্ধ। ময়লা রাখার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। যে যেখানে পারছে সেখানেই ময়লা ফেলছে। তিনি বলেন, বেডের নিচে, ওয়ার্ডের মেঝেতে ময়লা পড়ে থাকে। কেউ পরিষ্কার করে না। সাধারণ রোগীদের সঙ্গে নার্স থেকে শুরু করে আয়া পর্যন্ত খারাপ ব্যবহার করে।

শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অন্তত ২০টি ওয়ার্ড ঘুরে কোনো চিকিৎসকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এছাড়া বেশিরভাগ ওয়ার্ডেই সেবিকাদের উপস্থিতি কম ছিল। কিছু কিছু ওয়ার্ডের নার্সিং স্ট্রেশন পুরোপুরি ফাঁকা ছিল। বিভিন্ন ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয়রা দাবি করেন ছুটির দিনে কোনো সিনিয়র চিকিৎসকরা আসেন না। জরুরি প্রয়োজন হলে মোবাইল ফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে ডিউটি ডাক্তাররা সব সময় থাকেন। যদিও তাদের দাবি অস্বীকার করেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। নতুন ভবনের মেডিসিন বিভাগের ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডের রোগী হেমায়েত উদ্দিনের ছেলে জুয়েল রানা বলেন, আমার বাবাকে নিয়ে অনেকদিন ধরে হাসপাতালে আছি। ছুটির দিন সিনিয়র জুনিয়র কোনো চিকিৎসকই আসেন না। রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলেও পরামর্শের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেবিকাদের বললে তারা কোনো দায়িত্ব বা পরামর্শ দিতে রাজি হন না। জেনারেল সার্জারি ২২২ নম্বর ওয়ার্ডের রোগীর স্বজন পারভিন বেগম বলেন, নার্সরা এসে বেশিরভাগ সময় মোবাইল ফোনে কথা বলে না হয় বিশ্রামাগারে গিয়ে দরজা আটকিয়ে রাখে। প্রয়োজন হলে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বেশি ডাকাডাকি করলে ধমক দেয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ মানবজমিনকে বলেন, শুক্রবারে জরুরি অপারেশনসহ সবকিছুই হয়। সিনিয়র চিকিৎসকরা ছুটিতে থাকলেও অনকলে থাকেন। এছাড়া যাদের ভর্তি রোগী থাকে তারাই দায়িত্ব পালন করেন। ছুটির দিনে অন্তত ২০টি ওয়ার্ড ঘুরে কোনো ডিউটি ডাক্তারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তবে এমন হওয়ার কথা না। যদি এরকম হয় সুনির্দিষ্টভাবে আমাকে জানাবেন। আমি আর পরিচালক মিলে বসবো। আমরা সিরিয়াসলি বিষয়টি দেখবো। তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে কাজ না করে উপায় নেই। এখানেই রোগীদের শেষ ভরসা। কাজ না করলে এত রোগী ম্যানেজ হয় কীভাবে। গাছের আঘাত পেয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় আসা শিশু তৌহিদের চিকিৎসা পেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টারও বেশি। এ সময়ের ভেতরে তাকে কোনো চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ ছিল কি-না এমন প্রশ্নে- অধ্যক্ষ বলেন, অবশ্যই দেয়া যেত। এসবের জন্যই আমরা ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিস চালু করেছি। এখানে রোগী এলেই ওয়ার্ডে যাওয়ার আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে নিউরো সার্জারির রোগীদের জন্য সুবিধা করা হয়েছে। মানুষকে আরো বেশি সুবিধা দেয়ার জন্য এগুলো করা হয়েছে। শিশু তৌহিদের নাম ঠিকানা দেয়ার অনুরোধ করে তিনি বলেন, আমি নিউরো সার্জারির খোঁজ নেবো- তার ক্ষেত্রে কি হয়েছিল? আমি খুব খুশি হবো আপনারা যদি সহযোগিতা করেন।

উল্লেখ্য, সরকারিভাবে দেশের চিকিৎসাসেবার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বড় প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক)। ২ হাজার ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। অতিরিক্ত রোগীর চাপে এমনিতে এখানকার চিকিৎসক ও কর্মচারীদের হিমশিম খেতে হয়।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=157903&cat=2