৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ১১:৩৩

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি ঝুলে আছে ছয় মাস

এমপিওহীন স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ৯৪৯৮টি, শর্ত পূরণ করে ২ হাজার * লাগবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, আছে ৪৩২ কোটি

ঢাকঢোল পিটিয়ে আবেদন নেয়া হলেও ৬ মাস ধরে ঝুলে আছে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজ। শিক্ষকদের দাবির মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগস্টে এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আবেদন নেয়। তখন প্রায় সাড়ে ৯ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা আবেদনও করেছিল। এরপর প্রাথমিক যাচাইয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ‘ফিটলিস্ট’ ভুক্ত হয়। কিন্তু পরে আবেদন সরেজমিন যাচাই-বাছাইয়ের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ায় ঝুলে যায় এমপিওভুক্তি কার্যক্রম। এরপর ৬ মাস পেরোলেও তা আর শুরু হয়নি।


খোঁজ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জানা গেছে, ফিটলিস্ট চূড়ান্ত। এখন অর্থ বরাদ্দ এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হলে যে কোনো সময়েই আদেশ জারি সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, নতুন এমপিওভুক্তির জন্যই আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আবেদন নিয়েছি। বাস্তব কারণে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হয়েছিল। সেই কাজ চলছে। সবমিলিয়ে এমপিওভুক্তির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। বাজেট এবং যোগ্যতার নিরিখে চলতি অর্থবছরেই নতুন প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেয়া হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, এমপিওভুক্তির দাবিতে জুন-জুলাইয়ে শিক্ষকরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিওভুক্তির ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আবেদন নেয়া শুরু করলে আন্দোলন থেমে যায়। তখন নেয়া আবেদন প্রাথমিক বাছাই শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষদিকে। এর মধ্যে চলে আসে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু। অপরদিকে প্রাথমিক যাচাই শেষে দেখা যায়, শর্ত পূরণ করে মাত্র ২ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। এর মধ্যে স্কুল-কলেজ প্রায় ১২শ’, মাদ্রাসা ৫শ’ এবং সাড়ে ৩শ’ কারিগরি প্রতিষ্ঠান। সূত্রমতে, সাড়ে ৭ হাজার প্রতিষ্ঠান বাদ পড়লে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে- এমন আশঙ্কায় নির্বাচনের আগে সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। ফলে ওই পরিস্থিতিতে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের নামে সময়ক্ষেপণের কৌশল নেয়া হয়। ফলে ঝুলে যায় নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজ।

সূত্র জানায়, অনলাইনে নেয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা অনুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সফটওয়্যারে উল্লিখিত ফিটলিস্ট করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বয়স, শিক্ষার্থী সংক্রান্ত তথ্য, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার, অবকাঠামো ইত্যাদি বিবেচনায় নম্বর পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। সব মিলিয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে গ্রেডিং করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কর্মকর্তারা জানান, এমপিও পায় না এমন সাধারণ স্কুল ও কলেজ আছে সারা দেশে ৭ হাজার ১৪২টি। তবে এমপিওর জন্য অনলাইনে আবেদন করেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার। মাউশির এক হিসাবে দেখা গেছে, ৭ হাজার ১৪২টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে বার্ষিক ২ হাজার ১৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ২৫০ টাকা প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাউশির এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতিটি ডিগ্রি কলেজ এমপিওভুক্ত করতে বছরে লাগে ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫০ টাকা; উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৩ লাখ ৮০ হাজার, আর নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লাগে ১৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। বিভিন্ন পর্যায়ের মাদ্রাসাগুলোতেও ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় অভিন্ন।

অপরদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুল ও কলেজ এমপিওভুক্তি খাতে আছে মাত্র ৪৩২ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগে এর পরিমাণ আরও অনেক কম। কিন্তু এত কম টাকায় বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা অসম্ভব। এমন অবস্থায় করণীয় নির্ধারণে তারা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন।

তবে মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের দুটি চিন্তা আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্ত করা। আরেকটি হচ্ছে, এমপিওপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে পর্যালোচনা। কেননা, বর্তমানে এমপিওভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানে কাম্য ছাত্রছাত্রী নেই।

এ কারণে এর আগের সরকারের মন্ত্রীরা একাধিকবার বলেছেন যে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পার্শ^বর্তী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা হলে সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি অপচয় বন্ধ হবে। পাশাপাশি জনবলের সদ্ব্যবহার হবে। এ বিষয়টিও ভাবনার সময় এসেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে ২৬ হাজার ১৮০টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত আছে।

এর মধ্যে স্কুল ১৬ হাজার ১৯৭টি, কলেজ ২ হাজার ৩৬৫টি, মাদ্রাসা ৭ হাজার ৬১৮টি। এ খাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ আছে বছরে ১৪ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এ ব্যয় বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ৬৩ শতাংশের বেশি। যে সাড়ে ৯ হাজার প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে, সেগুলোকে এমপিও দিলে বছরে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এমপিও বিতরণকারী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন তিন অধিদফতরের হিসাব থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি জনপ্রিয় ইস্যুগুলোর অন্যতম। এর সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/140769