৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১২:১৫

রিজার্ভ চুরির ৩ বছর

মামলায় কেন এত দেরি

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরির তিন বছরের মাথায় অর্থ উদ্ধারে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক আরসিবিসিসহ সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এত দেরিতে মামলা করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন মনে করেন, ঘটনার ৬ মাসের মধ্যে মামলা হওয়া উচিত ছিল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও মনে করেন, মামলার জন্য এত সময় নেওয়া ঠিক হয়নি। যদিও অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে তারা আশাবাদী।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাইবার হামলা হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। অফিস সময় শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যাবেলা। রিজার্ভ চুরির তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ৩ ফেব্রুয়ারি। অজ্ঞাত হ্যাকাররা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়। আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের মাধ্যম সুইফটে ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে চুরি করা অর্থের মধ্যে শ্রীলংকা থেকে ২ কোটি ডলার আটকানো সম্ভব হয়। ফিলিপাইন থেকে পাওয়া গেছে দেড় কোটি ডলার। বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং আইনি খরচ ফেরত পেতে শুক্রবার মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলাটি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ দেওয়া ল ফার্ম কোজেন ও'কনর। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আরসিবিসির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা এই অর্থ চুরির জন্য কয়েক বছর ধরে 'জটিল ষড়যন্ত্র' করেন। গতকাল আদালত মামলাটি আমলে নিয়েছেন।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সমকালকে বলেন, ঘটনার ৬ মাসের মধ্যে মামলা করা উচিত ছিল। তৎকালীন গভর্নরকে নাকি ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ঘটনা প্রকাশ না করলে সমাঝোতার মাধ্যমে অর্থ ফেরত দেবে। কিন্তু ফিলিপাইন কথা রাখেনি। তাড়াতাড়ি মামলা করলে হয়তো এতদিন অর্থ ফেরত পাওয়া যেত। যদিও এখনও বাংলাদেশ অর্থ ফেরত পাবে বলে তিনি মনে করেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় দেরিতে মামলা করলে তা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে আরও আগে মামলা করলে ভালো হতো। তা ছাড়া আরসিবিসিসহ ফিলিপাইনের কোনো কোনে প্রতিষ্ঠান বংলাদেশের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে এখানকার লোকজন এ ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ করছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় এখন মামলা লড়ার সময় আরসিবিসি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর দোষ চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্টরা জানান, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে অর্থ ফেরত পাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ। যে কারণে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ ফেরতের চেষ্টা হচ্ছিল। প্রথমদিকে ফিলিপাইনের সিনেট, আদালতসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় মনে হয়েছে, শিগগিরই টাকা ফেরত আসবে। বিশেষ করে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন দেশটির আদালত, তা বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়া হবে বলে আশা ছিল। ফ্রিজ করা অর্থের মধ্যে সোলায়ের ক্যাসিনোর নামে আছে ২ কোটি ৯০ লাখ, ফিলরেমের ১ কোটি ৭০ লাখ এবং ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অংয়ের ৬০ লাখ ডলার। কিমঅংই এর আগে স্বেচ্ছায় দেড় কোটি ডলার ফেরত দিয়েছে। ফিলিপাইন সরকার চাইলে ফ্রিজ করা অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দিতে পারে বলে জানান সংশ্নিষ্টরা।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান সমকালকে বলেন, মামলার বাইরে টাকা উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। তবে তিন বছরের মধ্যে মামলা না করলে বিষয়টি হালকা হয়ে যায়। যে কারণে শেষ সময়ে মামলা করা হয়েছে। আবার নিউইয়র্ক ফেড যে এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে, সে চুক্তি করতেও সময় লেগেছে। এসব প্রস্তুতি শেষ করে মামলা করতে সময় লেগেছে। আরসিবিসি যদি এখনও মনে করে, মামলা না চালিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে টাকা ফেরত দেবে, সে পথও খোলা আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রে মামলা করা যায় না। মামলার জন্য বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে দেশটির আদালতে বিশ্বাসযোগ্য নথি উপস্থাপন করতে হয়েছে। এসব নথি সংগ্রহ এবং চুরির অর্থ ছাড়ে আরসিবিসির অসামাঞ্জস্যতার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরে মামলা করতে হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে সরকার এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। আর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা মতিঝিল থানায় একটি মামলা করেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও আজ অবধি এ মামলায় কোনো তদন্ত প্রতিবেদন তারা জমা দিতে পারেননি।

রিজার্ভ চুরি করে তা অজ্ঞাতনামা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের মতো এত বড় জালিয়াতিতে আরসিবিসির প্রধান কার্যালয়ের সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়। যদিও এ ঘটনায় ফিলিপাইনের আদালত গত ১০ জানুয়ারি শুধু আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছেন। এর আগে ফিলিপাইনের সিনেট, আদালতসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ আরসিবিসি থেকে বেআইনিভাবে অর্থ ছাড়ের বিষয়টি তুলে ধরে। বেআইনি কার্যক্রমের কারণে ২০১৬ সালের আগস্টে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরসিবিসিকে ১শ' কোটি পেসো বা প্রায় ২ কোটি ডলার জরিমানা করে।

https://samakal.com/economics/article/1902124