৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১২:০৬

যা ঘটেছিল মতিঝিলের সেই স্কুলে

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে বেআইনি অর্থ আদায় ও হয়রানির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বরখাস্ত করেছিল রাজধানীর মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদকে। গত ২৮শে জানুয়ারি এ ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিদ্যালয়টির সহকারী এক শিক্ষক কথা বলেন নুরজাহান হামিদের পক্ষে। অন্যদিকে বেআইনিভাবে অর্থ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকরা মুখ খুলেছেন। তারা বলছেন, ভর্তিবাবদ প্রধান শিক্ষক বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ আদায় করতেন। বৃহস্পতিবার সরজমিনে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়। সরকারি স্কুল হলেও ভর্তির সময় অর্থ আদায়ের অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা।

সেদিন কি ঘটেছিল? জানতে চাইলে বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদ এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারবেন না বলে জানান। তবে নুরজাহান হামিদ বিদ্যালয়টির এক সহকারী শিক্ষককে ডেকে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

এ সময় কিছু কাগজপত্র হাতে নিয়ে ক্ষণিক সময়ের মধ্যেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি। ২৮শে জানুয়ারির ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের ওই সহকারী শিক্ষক বলেন, আমি তো সেদিন ক্লাসে ছিলাম। তবে যতদূর জেনেছি হঠাৎ করেই দুদকের কর্মকর্তারা স্কুলে আসেন। প্রধান শিক্ষক তখন স্কুলের কাজে গেটের বাইরে ছিলেন। তারা আসার খবরে স্কুলে ফিরে আসেন। এ সময় আপার সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাদের কথা হয়। এর মধ্যে কি ঘটেছিল তা জানি না।

এই শিক্ষক বলেন, এই স্কুলে সকাল ও বিকাল দুই শিফট মিলিয়ে প্রায় ২৬শ’ শিক্ষার্থী। এ জন্য সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ছাড়া আরো ১২ জন প্যারা শিক্ষক রয়েছেন। যাদের জন্য সরকারি খাত থেকে কোনো বেতন দেয়া হয় না। এই ১২ জন প্যারা শিক্ষকের বেতন পাঁচ হাজার করে হলেও ৬০ হাজার টাকা বাজেট রাখতে হয় প্রতি মাসে। এছাড়া স্কুলের আয়া, বুয়া, গেটম্যান, নৈশপ্রহরী, ক্লিনারসহ বিভিন্ন কাজের লোকের জন্য সরকারি খাত থেকে কোনো বরাদ্দকৃত অর্থ নেই। এসব অর্থ জোগান দিতে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের কাছে থেকে ভর্তিবাবদ কিছু টাকা নেয়া হয়। সেটাও স্কুলের কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা করা হয়। কি পরিমাণ অর্থ নেয়া হয় জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষক বলেন, আমি এ বিষয়ে বলতে পারবো না।

এদিকে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের পৌঁছে দিতে আসা কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলে তাদের সন্তানদের ভর্তির সময় অর্থ আদায় করা হয়েছে। সবাইকেই দিতে হয়েছে। যার যেমন সামর্থ্য তার কাছ থেকে সেভাবেই অর্থ আদায় করেন নুরজাহান হামিদ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, আমার বাসা থেকে তিনজনকে ভর্তি করিয়েছি। তিনজনকে ভর্তি করতে ৫শ’ করে ১৫শ টাকা লাগছে। সরকারি স্কুলে ভর্তি করতে টাকা লাগবে কেন? আরেকজন অভিভাবক বলেন, ভর্তির সময় টাকা নেয়ার বিষয়টি একেকজনের কাছ থেকে একেক রকম। সামর্থ্য অনুযায়ী ১ হাজার, ২ বা চার হাজার টাকাও আদায় করা হয়। আরো কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, স্কুলের রেজাল্ট শিট নিতেও ২শ’ টাকা করে দেয়া লাগে। এটা বাধ্যতামূলক।

উল্লেখ্য, গত ২৮শে জানুয়ারি দুদক হটলাইনে ভুক্তভোগী অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের সহকারী পরিচালক নার্গিস সুলতানা ও উপ-সহকারী পরিচালক মো. সবুজ হাসানের সমন্বিত দল মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিযান চালায়। দুদকের অভিযানের বিষয়ে সংস্থাটি জানায়, অভিভাবকদের কাছ থেকে মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদা বাধ্যতামূলকভাবে বিনা রশিদে এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে নিচ্ছেন। এমনকি হতদরিদ্র ব্যক্তিদের সন্তানদেরও বিনামূল্যে ভর্তি করানো হয়নি, বরং তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ভর্তিবাবদ ওই প্রধান শিক্ষক ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা নিয়েছেন। উল্লেখ্য, এসব টাকার কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা হয়নি। প্রধান শিক্ষক দুদক টিমের কাছে অবৈধ অর্থ আদায়ের ঘটনা স্বীকার করেন। এ ঘটনা উদঘাটন হবার পরপরই মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। এরপরই প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদাকে বরখাস্তের আদেশ জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=157755