৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১১:৫৮

প্রতারণার শিকার মাধ্যমিকের ৫ হাজার এসিটি মডেল শিক্ষক

প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সারা দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ৫ হাজার ২০০ অতিরিক্ত শ্রেণিশিক্ষক। মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে সরকার ২০১৫ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছয় হাজার অতিরিক্ত শ্রেণিশিক্ষক নিয়োগ দেয়া শুরু করে। ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে অতিরিক্ত শ্রেণিশিক্ষক (এসিটি) হিসেবে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া কারো পক্ষে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব ছিল না। যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। অনেকের রয়েছে অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী। সাতজন এসিটি রয়েছেন স্বর্ণপদকধারী। অনেকে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। এসিটি শিক্ষকেরা জানান, তিন বছর মেয়াদে তাদের নিয়োগ দেয়া হলেও প্রকল্পের ম্যানুয়ালে বলা হয়েছিল তাদের চাকরি স্থায়ী করা হবে অথবা অন্য কোনো প্রকল্পে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু অত্যন্ত সফলভাবে ওই প্রকল্প শেষ হওয়ার ১৩ মাস পার হলেও তাদের শিক্ষকতায় স্থায়ী কিংবা অন্য কোনো প্রকল্পে আত্তীকরণের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। সর্বশেষ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের এমপিও ভুক্ত করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে (এসইডিপি) স্থানান্তরের সুপারিশ করা হলেও এখন তাদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানেও তাদের রাখা যাচ্ছে না। কারণ এসইডিপি রাজস্ব খাতের প্রকল্প।

অথচ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সংসদে প্রশংসিত হয়েছেন এসব এসিটি মডেলশিক্ষকেরা। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও সংসদে দাঁড়িয়ে এসব শিক্ষকের প্রশংসা করেছেন। প্রকল্প চলাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্তৃক বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের ভুয়সী প্রশংসা করে তাদের প্রকল্প ছেড়ে চলে না যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তাদের চাকরি স্থায়ী করার বিষয়ে বারবার আশ্বাসও দেয়া হয়েছে।

একজন শিক্ষক বলেন, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আমাদের এতই আশ্বাস দিয়েছে যে, তা দিয়ে মঙ্গলগ্রহ ঘুরে আসা যায়। কিন্তু এত আশ্বাসের পর এখন আমাদের বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে আমাদের পারিবারিক জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে।

এসিটি শিক্ষক প্রকল্প বিষয়ে শিক্ষকেরা জানান, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে সেকায়েপ প্রকল্পের অধীনে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে ছয় হাজার শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল মেধাবী শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত প্রণোদনার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট ও উৎসাহী করা। এই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে অতিরিক্ত শ্রেণিশিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যাতে শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং প্রাইভেট কোচিং নির্ভরতা কমে।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে প্রথম ধাপে তিন হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে চার ধাপে ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় তিন বছর মেয়াদে। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকেই বিসিএসসহ অন্যান্য চাকরিতে চলে যাওয়ায় শূন্যপদে আবার নিয়োগ দেয়া হয়। এমনকি প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই মাস আগেও শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে মোট পাঁচ হাজার ২০০ শিক্ষক রয়েছেন এ প্রকল্পের অধীনে।

সেকায়েপভুক্ত ২৫০টি উপজেলার ২ হাজার ১০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তারা নিযুক্ত আছেন। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের চাকরি চালিয়ে যেতে বলা হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত গত ১৩ মাস ধরে তারা বিনা বেতনে চাকরি করছেন। কিন্তু তাদের স্থায়ীকরণ বিষয়ে বারবার আশ্বাস দেয়া হলেও এখন তাদের এমপিওভুক্ত করা হবে না বা অন্য প্রকল্পেও নেয়া যাবে না মর্মে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশে এসিটি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কৌশিক চন্দ্র বর্মণ ও সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন জানান, শিক্ষক হিসেবে তাদের নিয়োগ দেয়ার সময় শর্ত দেয়া হয় যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৫০ শতাংশের ওপরে নম্বর পেতে হবে। এ শর্ত পূরণ করে যারা দরখাস্ত করবেন তাদের মধ্যে যাদের শিক্ষাজীবনের ফলাফল সবচেয়ে ভালো বা বেশি নম্বরধারী তাদের নিয়োগ দেয়া হবে। এভাবে মেধাবীরা চান্স পান এসিটি শিক্ষক হিসেবে। চান্স পাওয়াদের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের।

এ দুই শিক্ষক নেতা জানান, অনেককে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসায় নিয়োগ দেয়া হয়। তারা নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ানোর মতো করে স্কুলে অতিরিক্ত ক্লাস নিতেন। স্কুল বন্ধের দিন বা স্কুল শুরুর আগে বা পরে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন। এতে অনেক শিক্ষার্থী উপকৃত হয়। প্রতি মাসে একজন শিক্ষক কর্তৃক ১৬-২০টি অতিরিক্ত ক্লাসের মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য হ্রাস, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ভীতি দূরসহ বিষয়ভিত্তিক মান বৃদ্ধি, বাল্যবিয়ে রোধ, হোম ভিজিটের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া রোধসহ এসিটিদের বিভিন্ন কার্যক্রম অনেক প্রশংসনীয় হয়।

তারা জানান, গত বছরের ৪ জুলাই সংসদে প্রধানমন্ত্রী সেকায়েপের পাঁচ হাজার ২০০ জনসহ প্রকল্পভুক্ত কর্মরত শিক্ষকসহ ৯ হাজার ৮৪৭ জন অতিরিক্ত শ্রেণিশিক্ষকের প্রশংসা করেন। তারা নিয়মিত ক্লাসের বাইরে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান করছেন। ফলে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে। পরদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি গোলাম রাব্বানির সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘যেখানে পাসের হার ৫০ শতাংশের কম ছিল, সেখানে সেকায়েপভুক্ত এসিটিদের নিয়োগের ফলে পাসের হার শতভাগ হয়। এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে একমাত্র মেধাবী এসিটিদের দ্বারা।’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে সেকায়েপ প্রকল্পের মেয়াদ শেষে এসিটিদের এমপিও বা এসইডিপি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়।

গত ৩০ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে এসিটিদের এমপিওকরণের জন্য তিন কার্যদিবসের মধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছ থেকে এসিটিদের তালিকা চাওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত ১৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ হাজার ২০০ জন এসিটিদের আইনি জটিলতার কারণে এমপিও করা সম্ভব নয়। তাই তাদের এসইডিপি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এসিটি শিক্ষকেরা জানান, তাদের এসইডিপি প্রকল্পে রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও পরে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানেও তাদের রাখা হবে না।

শিক্ষকেরা জানান, আমাদের নিবন্ধন সনদ নেই, এসইডিপি রাজস্ব খাতের প্রকল্প, চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়ে এসিটি ম্যানুয়েল যারা লিখেছেন তারা ভুল লিখেছেন বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে। অথচ এসিটি ম্যানুয়েলে বলা আছেÑ কেউ এক বছর শিক্ষকতা করলে তাকে এনটিআরসিএ সনদ দেয়া হবে। কিন্তু আমাদের সে সনদ দেয়া হয়নি। অপর দিকে এসইডিপি প্রকল্পে ১২ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে কিন্তু সেখানে আমাদের নেয়া হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক থেকেও আমাদের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে পরবর্তী প্রকল্পে রাখার কথা বলা হয়েছে।

শিক্ষকদের দাবিÑ তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হোক। সেকায়েপভুক্ত মডেল এসিটিদের দক্ষতায় ডুবে যাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এ পর্যায়ে আসার পর যদি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই হয়Ñ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মডেল শিক্ষকদের বিভিন্ন শর্ত দিয়ে বাদ দেয়া। তাহলে মডেলশিক্ষকদের তিন বছরের শ্রমের মূল্য ও অভিজ্ঞতা কোথায় গেল? মন্ত্রণালয় বরাবরই বলছে, এসিটিরা অত্যন্ত মেধাবী ও অভিজ্ঞ; এসিটি মডেলশিক্ষকদের দ্বারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তাহলে সেকায়েপভুক্ত এসিটিদের প্রতি অবহেলা দেখাচ্ছে কেন? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদকে গতকাল রাতে এ বিষয়ে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আজ সকাল ৯টা থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন এসিটি শিক্ষকেরা।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/385491/