২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৫০

এই সহিংসতার শেষ কবে?

মাত্র ১৫শ’ টাকার জন্য প্রাণ দিতে হলো ৭ বছরের শিশু হৃদয় হোসেন সিদ্দিককে। নিখোঁজের চারদিন পর হৃদয়ের বস্তাবন্দি লাশ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। হৃদয় স্থানীয় জগৎমোহন স্কুলে প্লে গ্রুপের শিক্ষার্থী। গত ২৬শে জানুয়ারি বিকাল ৪টায় খেলার জন্য বাইরে যায় হৃদয়। সেখান থেকে পারিবারিকভাবে পরিচিত ইয়াসিন তাকে নিয়ে যায়। রাত হয়ে গেলে শিশুটি চিৎকার করতে থাকে। পরে শিশুটিকে জানায় তোমার বাবার কাছে ১৫শ’ টাকা পাবো। এটা পরিশোধ করলেই মুক্তি মিলবে।

তারপরও হৃদয় চিৎকার করায় মুখচেপে খুন করা হয় তাকে। সকালে কামরাঙ্গীরচর আলীনগর দুই নম্বর গলির ইলিয়াছের বাড়ির পাশের গলিতে একটি বস্তা পড়ে থাকতে দেখে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ বস্তার ভেতর থেকে হৃদয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করে। পরে হৃদয়ের বাবা রমজান আলী মৃতদেহ শনাক্ত করেন।

প্রতিদিনের মতোই দুই সন্তানকে মোটরসাইকেলে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন সামসুদ্দিন ডালিম। সন্তানরাও বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। কিন্তু নিমিষেই সব মিইয়ে গেছে। ট্রাক চাপায় নিহত হয়ে তারা এখন না ফেরার দেশে। গুরুতর আহত হয়েছেন সামসুদ্দিন ডালিম। নিহত সন্তানদের মরদেহ উদ্ধার করে নেয়া হয়েছে মর্গে আর বাবাকে নেয়া হয়েছে হাসপাতালে। ঘটনাটি গত সোমবারের। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মোল্লারপুল এলাকায় ঘটে এ ঘটনা। ট্রাক চাপায় নিহত সন্তানদের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি বাবা। তাদের মধ্যে আফসার হোসেন কেরানীগঞ্জের কসমো মেট্রোপলিটন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণি আর ফাতিমা আফরিন একই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করত। মোটরসাইকেলচালক বাবা সামসুদ্দিন ডালিমকে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ডেমরায় লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দুই শিশুকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় গোলাম মোস্তফা (৩০) ও আজিজুল বাওয়ানী (২৮)। ওই সময় শিশু দুটি চিৎকার করলে দু’জনকেই গলা টিপে হত্যা করে ঘাতকরা। এদিকে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মোস্তফা ও বাওয়ানী।

৫ই জানুয়ারি গেণ্ডারিয়ায় দুই বছর বয়সী এক শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ ওঠে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। নিম্নআয়ের পরিবারের ওই শিশুর মা সকালে মেয়েকে রেখে কাজে গিয়েছিলেন। খেলার জন্য শিশুটি ঘর থেকে বাইরে গিয়েছিল। ওই ফাঁকে পাশের বাসার অভিযুক্ত ব্যক্তি শিশুকে খিচুড়ি দেয়ার লোভ দেখিয়ে বাসায় ডেকে নেয়। ধর্ষণ চেষ্টার সময় শিশুটি কান্নাকাটি করলে তাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করে। এ ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নিজের মেয়েই আদালতে সাক্ষী দিয়েছে।

২৯শে জানুয়ারি ফেনীতে খেলাধুলা নিয়ে সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে আরাফাত হোসেন (১৩) নামের এক স্কুলছাত্রকে হত্যা করে মাটিতে লাশ পুঁতে ফেলার অভিযোগ উঠে। মো. সাব্বির হোসেন (১৫) নামের এক বখাটের বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তের মা ও ভাইকে আটক করেছে পুলিশ। নিখোঁজের ১৬ ঘণ্টা পর দুপুরে শহরের পাঠানবাড়ী এলাকার জিবি টাওয়ারের পাশে পরিত্যক্ত খালি জায়গা থেকে মাটি চাপা অবস্থায় আরাফাতের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আরাফাত হোসেন ফেনী পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৭ম শ্রেণির ছাত্র ও কুয়েত প্রবাসী জসিম উদ্দিনের ছেলে।

তারা শহরের পাঠানবাড়ী এলাকার একটি ভাড়া বাসায় বেশ কিছুদিন ধরে বসবাস করে আসছিল। আরাফাতের মামা এরশাদ হোসেন জানান, পাঠানবাড়ী এলাকার বখাটে সাব্বিরের সঙ্গে সমপ্রতি তার ভাগিনা আরাফাত হোসেনের খেলাধুলা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনার জেরে সাব্বির গত রোববার সন্ধ্যায় আরাফাতকে খেলার মাঠ থেকে ডেকে অন্যত্র নিয়ে যায়। পরে ওই এলাকার জেবি টাওয়ারের পাশের পরিত্যক্ত নির্জন জায়গায় স্থানীয়রা বখাটে সাব্বিরকে দেখতে পেয়ে আরাফাতের বিষয়ে জানতে চায়। এ সময় সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে আরাফাতকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে স্বজনরা ফেনী মডেল থানায় অভিযোগ করেন। পরদিন পরিত্যক্ত জায়গার এক কোণে মাটিতে একটি পা দেখতে পেয়ে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়। নিহত আরাফাতের মামা দাবি করেন বখাটে সাব্বির আরাফাতকে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও হত্যাসহ নানা ঘটনা ঘটছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু এই ঘটনার শিকার। কেন এমন নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে? সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের বিকৃত রুচিবোধ, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটই সব অপরাধের পেছনে ভূমিকা রাখছে। সংঘবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আর কঠোর আইন প্রয়োগ এ ধরনের বর্বরতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

চলতি বছরের প্রথম মাসে দেশব্যাপী গণমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৯টি। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১৯টি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১১৭৬টি। এর মধ্যে ৭৩২ জন নারী ও ৪৪৪ জন শিশু। আসকের ওই প্রতিবেদন বলছে, ৭৩২ জন নারীর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।

চলতি বছর ‘শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০১৮’ শীর্ষক শিশু অধিকার ফোরাম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে শিশুর ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর সারা দেশে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৮১২ শিশু। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৯৪ জন। শিশু নির্যাতনের এই চিত্রকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন মানবাধিকার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিতের মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, শিশুরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। কারণ হচ্ছে সমাজে এক শ্রেণির মানুষের প্রচণ্ডভাবে মূল্যবোধের অভাব থেকে। সামাজিক অস্থিরতার কারণে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে অপরাধীরা অনেক সময় মাদকাসক্ত অবস্থায় থাকেন। তখন তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এখানে অনেকটা মাদকাসক্ত, পারিবারিক শত্রুতা, অর্থের লোভ ইত্যাদি কারণে এসব কাজ করে। যে কারণেই হোক না কেন আমি মনে করি অপরাধীকে চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটা প্রতিরোধে বিচারহীনতা বা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। মোটকথা আমাদের প্রচণ্ড জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এটাকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি দিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে যে অপরাধ করলে পার পাওয়া যায় না। শাস্তি পেতে হয়।

অপরাধ বিজ্ঞানি তৌহিদুল হক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে শিশু নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনাটি বেশি ঘটছে। যেটা আতঙ্কের। যদিও প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের আলাদা আলাদা প্রেক্ষাপট রয়েছে। ট্রাক চাপায় দুই শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় ট্রাফিক নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং জনসচেতনতায় বড় একটি ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে শিশুদের প্রতিবাদ করার সুযোগটা কম থাকে। অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, যাদের মধ্যে ধর্ষণের চিন্তা রয়েছে তাদের কাছে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে পেলেই তার প্রতি সেই ‘রেইপ টেনডেনসি’র চিন্তা বা ভাবনা জাগ্রত হয়।

তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানুষের হিংস্রতা বেড়েছে। যুবসমাজ ও প্রাপ্তবয়স্করা ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি ব্যবহার করে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলো কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই উপভোগ করছে। এক কিশোর অপর কিশোরকে মেরে তার লাশ লুকিয়ে রাখবে এই ভাবনাটা ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও আমরা দেখিনি। এই অপ্রত্যাশিত হত্যাকাণ্ড প্রতিকারের উপায় হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারকে একটি শৃঙ্খলা বা অর্ডার তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্কের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো আচরণ তৈরি করা থেকে বিরত থাকবেন। যাতে করে ১৮ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত বাবা মায়ের সঙ্গে সব কথা তারা শেয়ার করে। আমাদের মূল সমস্যার জায়গা অর্থাৎ সামাজিকভাবে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটি তৈরি করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এবং অপরাধ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে অপরাধীর বিচার সম্পন্ন করতে হবে। কারণ ৬ মাস পর বিচার করা আর না করা একই কথা।

সমাজ বিজ্ঞানী ড. নেহাল করিম বলেন, ইদানীং প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং নারীদের তুলনায় শিশুরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। কারণ বড়দেরকে হত্যা বা নির্যাতন করতে গেলে আরো কয়েকজন ব্যক্তির সহযোগিতা লাগে। একা পারে না। অথবা মানুষ ভাড়া করতে হয়। কিন্তু একজন শিশুকে একটি মাত্র লজেন্স দিয়েই কাবু করা যায়। ঘর থেকে বের করা যায়। তাকে গুম, নির্যাতন, জিম্মি ইত্যাদি করে মুক্তিপণ আদায় করা যায়। আর সে কারণেই শিশুদের প্রতি পাশবিক অত্যাচার, ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। এ জন্য দায়ী সামাজিক মূল্যবোধ। এছাড়া জ্ঞান চর্চা এবং বোধশক্তির অভাবও এজন্য দায়ী। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে সামাজিক মূল্যবোধ, মানবতাবোধ ইত্যাদির চর্চা করতে হবে। তাহলেই এগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=157579&cat=3