২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৪৫

ব্যবহার হচ্ছে বিদেশী পণ্য বিক্রির বৈধ মার্কেট হিসেবে

বাণিজ্যমেলা নামেই ‘আন্তর্জাতিক’

দেখতে দেখতে দুই যুগ পার করেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। ১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া এ মেলা এবার তার ২৪তম আসর উদযাপন করছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে খোলা মাঠে শত শত কোটি টাকা খরচে স্থাপনা তৈরি করে আয়োজিত হয়ে আসছে এ মেলা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে আয়োজন করে এ মেলা। আয়োজকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছরই বাড়ছে মেলায় অংশগ্রহণকারী দেশ, প্রতিষ্ঠান, দর্শনার্থী, বিক্রি, রফতানি আদেশ প্রভৃতি। তবে দেশী উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় ‘আন্তর্জাতিক’ মান বলে কিছু নেই। এটি এখন সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের লাভালাভ এবং শুল্কমুক্ত উপায়ে বিদেশী পণ্য এনে বিক্রি করার একটি বৈধ মার্কেট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বছরই বাণিজ্যমেলার সময় এলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের ভাবমূর্তি এবং প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে দৃষ্টিনন্দন স্টল-প্যাভিলিয়ন তৈরি করে। আবার মাস শেষে এগুলো ভাঙার জন্য খরচ হয় আরো অনেক টাকা। ইপিবি এবং বাণিজ্যমেলা থেকে গত দশ বছর ধরেই বাণিজ্যমেলার স্থায়ী অবকাঠামোর কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে দুই যুগ পরে পূর্বাচলে যে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে সেটি আলোর মুখ দেখতে সময় লাগবে আরো অনেক বছর। দেশী বড় কোম্পানিগুলো মেলায় অংশগ্রহণকে নিয়েছেন ‘ফ্যাশন’ হিসেবে। মেলায় যে পরিমাণ খরচ হয়, বিক্রি হয় সে তুলনায় অনেক কম।

গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাণিজ্যমেলা কাভার করার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নামে আন্তর্জাতিক মেলা হলেও এখানে ‘আন্তর্জাতিক’ মানের কিছুই নেই। বিদেশীদের নামে প্যাভিলিয়ন সাজানো হলেও সেগুলোয় নেই ‘বিদেশী’র উপস্থিতি। বিদেশী হিসেবে প্রবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে স্টল-প্যাভিলিয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে। মেলার জন্য শুল্কমুক্ত উপায়ে বিদেশী পণ্য আমদানি এবং সেগুলো বিক্রির কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরাই করছেন। প্রথমদিকে মেলায় ইরান, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানি পণ্য নিয়ে সেসব দেশের কিছু লোক অংশগ্রহণ করলেও মেলাকেন্দ্রিক থাকা-খাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত না থাকায় ধীরে ধীরে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারাও।

এভাবে মেলা আয়োজন করে বিদেশী পণ্য বিক্রির অবাধ ব্যবস্থা করার তীব্র সমালোচনা করে একজন দেশী উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী, ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দের অর্থ ‘সব জাতি বা রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচলিত’। কিন্তু এই দুই যুগেও সব জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচলিত বা স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। তার দাবি, এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বাধীন ১৯৪টির দেশের মধ্যে ২৬টি রাষ্ট্র। এ হিসাবে বাণিজ্যমেলায় স্বাধীন দেশগুলোর অংশগ্রহণের হার মাত্র ১৩ শতাংশ। মেলায় প্যাভিলিয়ন, মিনি-প্যাভিলিয়ন, রেস্তোরাঁ ও স্টলের মোট সংখ্যা ৬০৫টি। বাংলাদেশ ছাড়া ২৫টি দেশের ৫২টি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছে। এই হিসাবে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো অবস্থান করছে মেলার ৯ শতাংশ স্থানজুড়ে। বাকি ৯১ শতাংশ দেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। কয়েক বছর ধরে আমরা যেটা দেখছি, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার হলেও রাজধানীর নিউ মার্কেটকে এখানে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরের বড় কোম্পানিগুলোকে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আন্তর্জাতিক মান নিয়ে ওঠা প্রশ্নের সাথে একমত আয়োজক প্রতিষ্ঠান রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস-চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্যও। এ ব্যর্থতা স্বীকার করে তিনি বলেন, বিদেশী বড় কোম্পানিগুলো মূলত মেলায় আসে সোর্সিংয়ের জন্য। আমরা কিন্তু সোর্সিং মেলা করছি না। তারা একটা গাড়ি নিয়ে আসবে, কিংবা অন্যকিছু নিয়ে আসবে। আমরা রাখব কোথায়, জায়গা নেই আমাদের। তিনি বলেন, এটা কিন্তু কনজ্যুমার ফেয়ার। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এ ধরনের কনজ্যুমার ফেয়ারে কোথাও যায় না। সোর্সিং মেলার জন্য আমরা অবকাঠামো তৈরি করছি পূর্বাচলে। ২০২০ সালে আমরা আশা করছি, পূর্বাচলে প্রথম সোর্সিং মেলা করতে পারব।

এদিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণখালীর বাগরাইয়াটেকে ২৬ একর জমির ওপর বাণিজ্যমেলার স্থায়ী কাঠামো নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার কমপ্লেক্স’ (বিসিএফইসি) নামের প্রকল্প। মেলাকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে ২০১৫ সালে চীনের সহায়তায় ৭৯৬ কোটি টাকার এ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। চীন সরকার দিচ্ছে ৬২৫ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১৭১ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, চীন সরকার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চাইনিজ স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন নামের প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তবে এখনই তা আর্জাতিক মানসম্পন্ন হচ্ছে না। পূর্ণাঙ্গ মেলার রূপ পেতে আরো অন্তত ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে, বাড়বে খরচও।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/385202