২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৩৭

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর শূন্য থাকছে ১৩ লাখ আসন

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজ, বিশেষ করে বেসরকারি কলেজগুলো তীব্র শিক্ষার্থী সঙ্কটে ভুগছে। সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে ২০১৭ সালে ১৩ লাখ আসন শূন্য ছিল। ২০১৬ সালে এ শূন্য আসনের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৭২ হাজার।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

এক দিকে প্রতি বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির তীব্র ভিড়, অপর দিকে সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে এভাবে আসন শূন্য পড়ে থাকা অনেকের কাছে যেমন বিস্ময়কর তেমনি দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্নের।

ইউজিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে সারা দেশের কলেজে মোট শিক্ষার্থী ভর্তির আসনসংখ্যা ছিল ২১ লাখ ১৬ হাজার। এসব আসনের বিপরীতে ওই বছর শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে মাত্র সাত লাখ ৭৪ হাজার। আসন শূন্য ছিল ১৩ লাখ ৩১ হাজার। এতে আরো বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি বা স্নাতক পাস পর্যায়ে প্রথম বর্ষে ভতির আসনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ এক হাজার। ডিগ্রি অনার্স পর্যায়ে প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন ছিল চার লাখ ১২ হাজার। ডিগ্রি পাস ও অনার্স মিলিয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন ছিল মোট ১৯ লাখ ১৪ হাজার। আর ২০১৭ সালে এ আসনের বিপরীতে ভর্তি হয় মাত্র ছয় লাখ ৩১ হাজার শিক্ষার্থী।

একই বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পাস, ডিগ্রি অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেটসহ মোট আসনসংখ্যা ২১ লাখ ১৬ হাজার ৫০৪টি। এর বিপরীতে ভর্তি হয়েছে সাত লাখ ৭৪ হাজার ৬৮৯ জন। আসন শূন্য ছিল ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৮১৫ জন শিক্ষার্থী।

অপর দিকে ২০১৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পাস পর্যায়ে প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন ছিল ১৪ লাখ ৮৮ হাজার ১০০টি। ভর্তি হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩০১ জন। ডিগ্রি অনার্সে আসন ছিল ৪ লাখ ১২ হাজার ৪৬৫টি। ভর্তি হয় ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৫৯৯ জন। ডিগ্রি পাস ও অনার্সে মোট আসন ছিল ১৯ লাখ ৫৬৫টি। ভর্তি হয়েছে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৯শ জন। সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত মোট কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ২৬৯টি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে আসন শূন্য থাকা বিষয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, নিতান্ত বাধ্য হয়ে এখানে ভর্তি হন অনেক শিক্ষার্থী। এইচএসসি পাস করার পর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা ভর্তি হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু যাদের সে সামর্থ্য নেই তারা বাধ্য হয়ে ভর্তি হন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কোনো কলেজে। সে ক্ষেত্রেও তাদের লক্ষ্য থাকে নামকরা কোনো সরকারি কলেজ। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পর কোনো সরকারি কলেজেও চান্স পায় না যারা তাদের শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হয় কোনো বেসরকারি কলেজ। আর এ ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা মনে করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেসরকারি কোনো কোনো কলেজে পড়ার চেয়ে না পড়া ভালো। এক দিকে বেরসরকারি কলেজে অনার্সে পড়ার খরচ বেশি তারপর প্রশ্ন রয়েছে মান নিয়ে।

সে কারণে দেখা গেছে অনেক শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়নি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়ার সামর্থ্য নেই। কিন্তু তারপরও তাদের অনেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে ভর্তি হচ্ছে না। অনেকে ইয়ার লস দিয়েও কোথাও চান্স না পেয়ে পড়ালাখায় ইস্তফা দেয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান সরকারি কলেজে তেমন কোনো শিক্ষার্থী সঙ্কট নেই।

মূলত, গ্রামপর্যায়ের বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে এ সঙ্কট তীব্র। এমনকি রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা শহর, বড় বড় উপজেলা শহরে অবস্থিত অনেক বেসরকারি কলেজেও শিক্ষার্থী সঙ্কট রয়েছে।
এর কারণ হিসেবে অনেক শিক্ষক বলেন, বেসরকারি বিভিন্ন কলেজের অনার্সের ক্ষেত্রে নি¤œমানের কারণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নেই। অনার্সের-মাস্টার্সের নামে অনেক কলেজে নৈরাজ্য চলছে। শিক্ষক নেই, ক্লাস নেই। তারপর রয়েছে বেশি খরচ। সাত থেকে ১০ হাজার টাকা লাগে ভর্তি হতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বিবেচনায়, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে, নানা ধরনের তদবির করে অনেক কলেজকে অধিভুক্ত করা হয়েছে। কোনো একটি এলাকায় হয়তো প্রয়োজন নেই তারপরও কলেজকে অধিভুক্ত করা হয়েছে নানা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে। শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে কি না, সে বিবেচনা করা হয়নি। তা ছাড়া, অনার্স-মাস্টার্স খুলতে পারলে কলেজের অনেকে অনেক ধরনের সুবিধা পান। তা ছাড়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সারা বছর থাকে পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। এসব কলেজে যথাযথ তদারকি করা হয় না। বছরে শতাধিক পরীক্ষার কারণে শিক্ষকরাও ব্যস্ত থাকেন। পরীক্ষার কারণে তাদের অনেকে ঠিকমতো ক্লাসও নিতে পারেন না। অনেক সময় পরীক্ষার কারণে শ্রেণীকক্ষেরও অভাব দেখা যায়। রয়েছে অবকাঠামোগত সমস্যা। তা ছাড়া, অনেক বিষয়ে এখনো সেশন জট রয়েছে।

এ কর্মকর্তা আরো বলেন, আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হতো সব শেষে। কিন্তু এখন ভর্তি অনেক এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এ কারণেও বঞ্চিত হচ্ছে অনেকে।

রাজধানীর একটি কলেজের একজন শিক্ষক জানান, অনলাইনে ভর্তির কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ভর্তিতে ব্যর্থ হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকে অনলাইনে ভর্তির বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না। তারা অনেকে সরাসরি কলেজে এসে যোগাযোগ করে ভর্তির তারিখ শেষ হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু তখন করার কিছু থাকে না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা টি আলী কলেজের শিক্ষক খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, প্রায় সব উপজেলায় এখন সরকারি কলেজে হয়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে তারা অন্তত বেছে নেন সরকারি কলেজকে। সেখানে খরচ অনেক কম।

খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, বেসরকারি কলেজে ভর্তির বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নীতিমালা নেই। যে যেমন করে পারছে ভর্তি ফি, বেতন, সেশনচার্জ নির্ধারণ করছে। অনেকে অনার্সে ভর্তির পর ভর্তি বাতিল করে ডিগ্রিতে ভর্তি হতে চান। কারণ, ডিগ্রির পড়া তুলনামূলক সহজ এবং খরচও কম।

অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে যুগোপযোগী বিষয় না থাকায়ও অনেকের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অবস্থিত নাম করা একটি কলেজের একজন শিক্ষক জানান, তাদের কলেজে অনার্সে ভর্তি হতে ১০ হাজার টাকার বেশি লাগে। মাসে বেতন ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। তা ছাড়া, প্রতি বছর সেশন চার্জ দিতে হয় ১০-১২ হাজার টাকা। কলেজের সুনাম অনুযায়ী এ চার্জ ভিন্ন ভিন্ন কলেজে ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়ে থাকে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ লাখ আসন খালি এটি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য। অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন, অনেক বেসরকরি কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেক বেশি আসন দেখায়। আসলে তাদের এত আসন নেই বা তারা এত শিক্ষার্থী পাবে না এটাও জানে। এত বেশি আসন খালি থাকার পেছনে এটা একটা কারণ হতে পারে।

গত বছর ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৭ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাশ করেছে আট লাখ ৫১ হাজার ৮০১ জন।

দেখা যায়, প্রতি বছর ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পাসকরা শিক্ষার্থীদের প্রায় দ্বিগুণ আসন রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষে।

ইউজিসির প্রতিবেদনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির আসনসংখ্যা উল্লেখ করে বলা হয়েছে এইচএসসি পাস করা সব শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সুযোগ রয়েছে বর্তমানে দেশে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীন কলেজে আসন শূন্য থাকা বিষয়ে ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ এবং এ বিষয়ক ডিন প্রফেসর ড. নাসির উদ্দিনকে বারবার ফোন করা হলেও তারা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/385207