১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ৮:২৬

বেদখল ঢাকার পার্ক-মাঠ

দুই সিটির ১২টিরই অস্তিত্ব নেই

রাজধানীর পুরান ঢাকার নারিন্দা শিশুপার্কটি এখন অস্তিত্বহীন। নারিন্দার শিশুদের জন্য স্থাপিত এ পার্কটি দখল করে রেখেছে লায়ন্স ক্লাব নামে একটি সংগঠন, যা স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত। তারা এর বিশাল অংশজুড়ে একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করে দখল করে রেখেছেন। এখন পার্কের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

ডিএসসিসির পার্কের তালিকায় নারিন্দাতে ‘নারিন্দা পার্ক’ নামের আরো একটি পার্কের নাম পাওয়া যায়। এ পার্কটির আয়তন ০.১৫৯৮ একর। নারিন্দা এলাকার পুরনো ও স্থায়ী বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে ও ঘুরে জানা গেছে, ওই এলাকায় আগে নারিন্দা শিশুপার্ক ও নারিন্দা পার্ক নামে দুটো পার্ক ছিল। শিশুপার্কটি দখলে রেখেছে লায়ন্স ক্লাব, নারিন্দা পার্কটিতেও একটি কমিউনিটি সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে।

প্রায় ৩৫ শতাংশ জায়গাজুড়ে মতিঝিল বিআরটিসি ভবনের বিপরীতে অবস্থান মতিঝিল পার্কটির। ডিএসসিসি নিয়ন্ত্রিত এ পার্কটির এখন বেহাল দশা। পার্কের বাউন্ডারির গ্রিল ভেঙে করা হয়েছে একাধিক প্রবেশ গেট। পার্কের ভেতরে বসানো হয়েছে ১০ থেকে ১২টি দোকান। এসবের মধ্যে খাবার হোটেল, চা-পান ও সিগারেটেরও দোকান বসানো হয়েছে। পুরো মাঠজুড়ে ফেলে রাখা হয়েছে ময়লা-আবর্জনা। গাছপালা কেটেও পার্কটি দখলের পাঁয়তারা চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের এক কর্মচারী জানান, মতিঝিলের এ পার্কের তেমন কোনো চিহ্ন বর্তমানে নেই বললেই চলে। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এখানে অসংখ্য দোকানপাট বসিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগেরই লোকজন। মাঝে মধ্যে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। তবে ডিএসসিসির লোকজন আগে থেকেই দোকানদারদের সতর্ক করে দেয়। নামকাওয়াস্তে অভিযান চালানোর পরদিন থেকেই আবারো দোকান বসানো হয়।

নগরবাসীর শরীর চর্চা ও বিনোদন আর শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে রয়েছে ৫৪টি পার্ক ও ২৫টি খেলার মাঠ। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ২৯টি পার্ক ও ১৫টি খেলার মাঠ আর উত্তর সিটিতে ২৫টি পার্ক ও ১০টি মাঠ রয়েছে। এসব পার্ক-মাঠের মধ্যে ১২টির কোনো অস্তিত্বই নেই।

যে কয়টি মাঠ ও পার্কের অস্তিত্ব রয়েছে, সেগুলোও যথাযথ নজরদারি না থকার কারণে একের পর এক দখল হয়ে যাচ্ছে। দখল হয়ে যাওয়া এসব পার্কে ও মাঠে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকান, ক্লিনিক, আড়ত, রেন্ট-এ কার স্ট্যান্ড, গাড়ির গ্যারেজ, মালামাল রাখার গুদাম ইত্যাদি। কোনো কোনো পার্ক ও মাঠ ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে আছে। এ ছাড়া যেসব পার্ক মাঠ এখনো দখল হয়নি কিংবা আংশিক দখল হয়ে আছে, সেগুলো ঘিরেও চলছে দখল-বেদখলের প্রতিযোগিতা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রিত এ সব পার্ক ও মাঠ ছাড়াও রাজউকের অধীনে থাকা একসময়কার মনোমুগ্ধকর রমনা, সোহরাওয়ার্দী ও চন্দ্রিমা উদ্যানও এখন দখল, দূষণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দায়িত্বশীল বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার সাথে কথা বলে ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পার্কগুলো সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মোহাম্মদ জামাল মোস্তফা বলেন, নাগরিকদের সুস্থ বিনোদন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। তাই সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া পার্ক বা দখল হয়ে যাওয়া খেলার মাঠ উদ্ধারে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পার্ক ও খেলার মাঠগুলো নিয়ে ‘জলসবুজে ঢাকা’ নামে একটি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এই কাজগুলো করছি। এসব পার্কে শিশুদের খেলাধুলা, বড়দের হাঁটাচলা, আধুনিক টয়লেট এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকছে। অত্যাধুনিক নকশার সঙ্গে জনগণের মতামতকে যুক্ত করে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। যেগুলোর কাজ এর আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে।

রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ১৫ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত জাতীয় শিশুপার্ক। পার্কটির চারদিক বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা। রাজধানী ও আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন বিনোদনের জন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে আসেন এখানে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও রয়েছে পার্কটির সুনাম। সরকারি ও বেসরকারি বিনোদন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম খরচ হওয়ায় ধনী-গরিব প্রতিটি পরিবারের কাছে জনপ্রিয় ছিল এটি। সংস্কার কাজের জন্য গত ১ জানুয়ারি থেকে এক বছরের জন্য ৪০ বছরের পুরনো এ পার্কটি বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করে পার্কটি বন্ধ করে দেয়ায় অনেকেই শিশু-সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে এসে পড়ছেন বিপাকে।

সরেজমিন দেখা গেছে, পার্কের ভেতরে ভাঙচুর ও সংস্কার কাজ চলছে। বড় বড় বুলডোজার দিয়ে রাইডগুলো ভাঙা হচ্ছে। সেগুলো এদিকে-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। টিকিট কাউন্টারগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। দক্ষিণ দিকের ফুডকোর্টগুলো ভাঙার কাজ চলছে। বড় বড় মাটিকাটার ড্রেজার মেশিনে মাটি খুঁড়ে গর্ত করা হচ্ছে।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের (তৃতীয় প্রকল্প) অধীনে ৫০০টি ভ‚গর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং, দৃষ্টিনন্দন জলাধারসহ হাঁটার পথ, আন্ডারপাস, মসজিদ ও অত্যাধুনিক রাইডসহ শিশুপার্কের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। প্রকল্প মেয়াদকাল জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯।

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডবিøউবিবি) ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সূত্রে জানা গেছে, একটি সুন্দর ও পরিকল্পিত নগরের বাসিন্দাদের জন্য নগরের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ খোলা মাঠ ও পার্ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় এ জন্য আছে মাত্র চার শতাংশ জায়গা। আর যা আছে তাও চলে যাচ্ছে দখলদারদের কবলে। তাদের মতে, একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় নান্দনিকতা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, বিনোদন ও শরীর চর্চার জন্য মাঠ ও পার্কের প্রয়োজন। এ হিসাবে রাজধানীতে গড়ে দুই লাখ ৩০ হাজার ৭৬৯ জন মানুষের জন্য পার্ক কিংবা খেলার মাঠ আছে মাত্র একটি।

সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও এ পার্কগুলো এখন অপরাধীদের আনাগোনা এতই বেশি যে, দর্শনার্থীদের প্রায়ই নিরাপত্তা সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয়। মাতাল, মাস্তান, ছিনতাইকারী, দেহপসারিণী ও পুলিশের যুগপৎ অত্যাচারে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে পার্কে বেড়াতে আসা সাধারণ লোকজন।

প্রায় ৬২ শতাংশ জায়গাজুড়ে অবস্থান যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পার্ক। পার্কটি এক অংশ দখল করে রেখেছে খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অঞ্চল ৫-এর অফিস। অন্য অংশটি স্থানীয় হকারদের ভ্যানগাড়ি দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে। পার্কটিতে গাছপালার কোনো চিহ্নও নেই। পার্কের যত্রতত্র দেখা গেছে ময়লার ভাগাড়।

প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ধানমন্ডি পার্ক। পার্কটিতে রয়েছে শিশু-কিশোর ও সব বয়সের লোকজনের আনাগোনা। পার্কের ভেতর ব্যায়ামের কিছু যন্ত্রপাতি ছিল তা এখন নেই। তবে এখনো যে কয়েকটি রয়েছে তা সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন মোড় ও জিরো পয়েন্টের মাঝখানে প্রায় ৮৩ শতাংশ জায়গাজুড়ে অবস্থিত মুক্তাঙ্গন পার্ক। পার্কটি বেদখল হওয়ায় এখন আর চেনার উপায় নেই। এটি এখন পার্ক নয়, রেন্ট-এ কার ব্যবসাকেন্দ্র। পার্কটি এক সময় রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন সংগ্রামের মূল কেন্দ্র ছিল। অনুমোদন ছাড়াই একটি অংশ ব্যবহার করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। দখল পাকাপোক্ত করতে কেটে নেয়া হয়েছে গাছ। বসার বেঞ্চগুলো এখন অস্তিত্বহীন।

এ ছাড়া ডিসিসি উত্তরের অঞ্চল-৫-এর অফিস সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে ২ নম্বর ডিসিসি মার্কেটের পশ্চিমে কাওরান বাজার শিশুপার্ক এখন পাইকারি কাঁচামালের আড়ৎ। ডিসিসির কাগজপত্রে আছে অথচ বাস্তবে নেই রায়েরবাজার পার্কটি। পশু হাসপাতালের সামনের পার্কটি কোনো কালে আদৌ ছিল কিনা কেউ বলতে পারবেন না। লালবাগের রসুলবাগের পার্কটি পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে। নয়াবাজারে নবাব সিরাজউদদৌলা পার্কের চারপাশ হয়ে আছে বেদখল। আজিমপুর শিশুপার্কে কাঁচামালের দোকান, টয়লেট ও কমিউনিটি সেন্টারের কারণে শিশুরা তো দূরে থাক, বয়স্করাও যেতে স্বস্তিবোধ করেন না। এভাবে ডিএনসিসির অন্তর্ভুক্ত মোহাম্মদপুরের শহীদ শাকিল পার্ক, শিয়া মসজিদ পার্ক, ইকবাল রোড মাঠ পার্ক, ফার্মগেট ত্রিকোণ পার্ক, শেরশাহসূরি লেন পার্ক, তাজমহল রোড পার্ক, লালমাটিয়া ডি-বøক পার্ক, হুমায়ুন রোড পার্ক, উত্তরা পার্কগুলোও পর্যায়ক্রমে দখলদের কবলে চলে যাচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পার্ক ও খেলার মাঠের আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সবুজায়ন প্রকল্পের আওতায় ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ২২টি পার্ক ও চারটি খেলার মাঠ সংস্কার করে অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি খুলে দেয়া হয়েছে। বাকি কয়েকটির সংস্কার কাজ চলছে এবং অন্যগুলোর নকশা চ‚ড়ান্ত করে টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/183131