১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ৮:১৫

জানুয়ারিতে রাজপথে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জন নিহত

রাস্তায় পিষ্ঠ হচ্ছে স্বপ্ন

বাবা ডালিম হোসেন দুই শিশুসন্তান আফসার ও আফরিনকে প্রতিদিন স্কুলে আনানেয়া করতেন। আফসার চতুর্থ আর আফরিন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ওই স্কুল দু’টি বাসা থেকে কিছু দূরে। গত সোমবার সকালেও দুই শিশুসন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসেন ডালিম। বেলা ১১টার দিকে বাসায় ফেরার পথে একটি ঘাতক ট্রাক কেড়ে নেয় দুই ভাইবোনের প্রাণ। ট্রাকচাপায় আহত হন ডালিম নিজেও। এভাবেই দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক বেপরোয়া চালকরা কেড়ে নিচ্ছে পথচারীদের জীবন। গত এক মাসে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জনের উপরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এভাবেই রাস্তায় ঝরে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন, ভালোবাসা, জীবন। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পুরো পরিবারটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারিতে এমন ঘটনাও ঘটেছে। আবার কোনো কোনো পরিবার একাধিক সদস্যকে হারিয়ে দিশেহারা। কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কোনো কোনো পরিবার সারাজীবনের জন্য পথে বসে যাচ্ছে। উপোষ থেকে তাদের দিন কাটছে। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে সারা জীবনের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছেন পরিবারের।

লালমনিরহাটের মোরসালিন, মাসুম, মৃণাল খণ্ডকালীন কাজের জন্য গিয়েছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানে একটি ইটভাটায় কাজ করতেন তারা। পরিবারের সচ্ছলতা, আর নিজেদের পড়ালেখার খরচ চালাত ওই টাকা দিয়ে। কিন্তু ঘাতক ট্রাক কেড়ে নিলো তাদের জীবন। সেখানে ১৪ জন নিহত হন। গত ২৫ জানুয়ারি রাতে চৌদ্দগ্রামের ছুপুয়া-নালঘর সড়কের পাশে নারায়ণপুর গ্রামে কাজী অ্যান্ড কোম্পানি ইটভাটায় টংঘরে ঘুমাচ্ছিলেন তারা। এ সময় কয়লাবাহী একটি ট্রাক উল্টে ওই ঘরের ওপর পড়ে। তাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ওই ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।

গত ২৩ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরে মান্দারী এলাকায় একই পরিবারের ৬ জন ট্রাকচাপায় নিহত হন। এরা সবাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার জগদিশপুর এলাকার বাসিন্দা। নাদিম মাহমুদ নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে লক্ষ্মীপুরে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে আহত করে। তাকে লক্ষ্মীপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভোর বেলায় নাদিমের বাবা শাহ আলম পুরো পরিবার নিয়ে লক্ষ্মীপুর যাচ্ছিলেন। পথে একটি ট্রাক তাদের বহনকারী অটোরিকশাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই পুরো পরিবারটি শেষ হয়ে যায়।

গত ১৫ জানুয়ারি বি.বাড়িয়ার বিজয়নগরে বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস খাদে পড়ে ৬ জন নিহত হয়। ৬ জানুয়ারি নেত্রকোনায় বাসচাপায় তানিয়া এবং তার শিশুসন্তান মোমেন নিহত হয়। আহত হন তানিয়ার মেয়ে হাবিবা। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা নেত্রকোনায় গিয়েছিল। এভাবেই একের পর এক প্রাণহানি ঘটছে সড়ক-মহাসড়কে। যারা প্রাণহানির জন্য দায়ী অনেক ক্ষেত্রে তাদের কোনো বিচারই হচ্ছে না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাদের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সেই চালকরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানুষ হত্যার পরও তাদের অনেককে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা ব্যাপকহারে বেড়েছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন দুর্ঘটনা ঘটছে না এবং প্রাণহানি হচ্ছে না।

রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, চালকরা দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এর প্রধান দু’টি কারণ। প্রথমত, চালকরা জানে গাড়িচাপায় মানুষ মেরে ফেললেও তাদের কোনো সাজা হবে না। তাদের সাজা দেয়ার চেষ্টা করা হলে ধর্মঘট করে, রাস্তা অবরোধ করে সব কিছু অচল করে দেবে। আর এ কারণেই তারা মানুষ মারতে দ্বিধা করে না। দ্বিতীয়ত, তাদের কোনো শিক্ষা নেই। নৈতিক শিক্ষাও নেই, গাড়ি চালানোর দক্ষতাও নেই। ফলে তারা দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সাইদুর রহমান এ জন্য গাড়ির মালিক ও সরকারকেও দুষলেন। তিনি বলেন, সরকার মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে না।

নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেছেন, দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। দক্ষ চালক তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, এই দায়িত্ব সরকার এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর। এই সুযোগে অদক্ষ শ্রমিকরা গাড়ি চালাচ্ছে। আর দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা নয়া দিগন্তকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা বেড়েছে সত্য। এটা হয়েছে চালকদের অস্থিরতার জন্য। চালকদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদেরকে মালিকপক্ষের নির্যাতনের মধ্যে থাকতে হয়। তাদের সঠিক কোনো গাইড লাইন নেই। বিশৃঙ্খল নেতৃত্বের কারণে তারা গাইড লাইন পান না।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/384961