১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ৮:১৪

দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত

মুহাম্মদ নূরে আলম : দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাচ্ছেন বিভিন্ন বেসকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। আবার চিকিৎসার জন্য যে টাকা খরচ হচ্ছে সেখানে ৭০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে ওষুধ কেনার জন্য জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সূত্রে। বাংলাদেশে ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট ( এএনএইচ) জানাচ্ছে জনপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ৬৭ টাকা খরচ হচ্ছে মানুষের পকেট থেকে। দেশের উন্নয়ন স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজন জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এজন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (ইউএইচসি) বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি কেমন হবে, এর আওতায় সেবার পরিধি কতটা থাকবে, জনঅংশগ্রহণ কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে, আর্থিক নিশ্চয়তা ইত্যাদি নীতি-নির্ধারণেই কেটে গেছে পাঁচ বছর। এতে এটি বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আর এসব দুর্বলতায় মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে এবং প্রতি বছর শুধু অসুস্থতার কারণে প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যসেবার এই খরচ মেটাতে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন এবং গরিব থেকে আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে এসব মানুষ। এমন পরিস্থিতিইে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এর সুফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ৪০ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা হলেও ৫০ ভাগ মানুষ গুণগত স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে না। দেশে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যব্যয় দিনকে দিন বাড়ছে। অথচ সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজিস এর ১৭ টি উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম। অথচ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দরকার। তা না হওয়ায় দেশে ধনী-গরিব সব শ্রেণীর মানুষ চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ ব্যয়ের জন্য দেশের ১৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আর এর কারণ হিসেবে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের অধিকাংশ ওষুধের পেছনে ব্যয় হলেও ওষুধের অতি ব্যবহার, ডায়াগনসিস সার্ভিস, অস্ত্রোপচারের উচ্চমাত্রার খরচ, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কেবিন এবং বেডের উচ্চমূল্য, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চেম্বারগুলোতে চিকিৎসকদের উচ্চমাত্রার ফি, সরকারি বা পাবলিক হাসপাতালগুলোতে অবৈধ লেনদেন, সরকারি সুযোগ সুবিধার চেয়ে বেসরকারি সুযোগ সুবিধার বেশি ব্যবহার এবং শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বেসরকারি চিকিৎসার উপর নির্ভরশীলতা চিকিৎসা ক্ষেত্রে মানুষের খরচ বাড়িয়ে চলেছে বলে বলছেন তারা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, সরকারের বাজেট বাড়ছে। অপরদিকে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ (ইউএইচসি) প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও তারা এটি নিয়ে কাজ করছে। তবে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সাবেক পরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, কোন ব্যক্তির মোট আয়ের মধ্যে যদি ২০ শতাংশ চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয় তাহলে বুঝতে হবে তিনি চিকিৎসার জন্য আর্থিক বিপর্যয়ে রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ঢাকার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাচ্ছে না। তাই বিগত ৫ বছর ধরে ইউএইচসি শহর, নগর, গ্রাম থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবার মাঝে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে যতটুকু সেবা দরকার ততটুকু দিতে হবে। এমনকি এ জন্য যতটুকু খরচ তার বেশি যেন না হয়, সেটিই কোয়ালিটি হেলথ কেয়ার। সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক যেটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেখানে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, হেলথ এ্যাসিসটেন্টরা শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে কোয়ালিটি সেবা দিতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে- যতটুকু সেবা দরকার ততটুকু দিতে হবে। এমনকি এ জন্য যতটুকু খরচ তার বেশি যেন না হয়, সেটিই কোয়ালিটি হেলথ কেয়ার। প্রথমত কোয়ালিটি হেলথ কেয়ার হল মেডিকেল আসপেক্ট বা চিকিৎসকের ডায়াগনোসিস ও প্রেসকিপশন সুবিধা যা কোয়ালিটি সেফটি। আরেকটি হল নন-মেডিকেল আসপেক্ট অর্থাৎ রোগীকে গুরুত্ব কম দিয়ে দেখা বা ডায়গনোসিস না করা বা যতটুকু ইফিসিয়েন্সি আছে সেটা না করা। যেগুলো পরিপূর্ণভাবে হওয়াই কোয়ালিটি সেবা। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেখানে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, হেলথ এ্যাসিসটেন্ট ও এফডব্লিউ’রা শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে কোয়ালিটি সেবা দিতে পারছেনা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মুজাহেরুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিবছর ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে আমাদের দেশে কেবলমাত্র স্বাস্থ্যব্যয় মেটাতে গিয়ে। আর এ খরচের প্রধান এবং অন্যতম খরচ হচ্ছে ওষুধ কেনাকেটায়। তাই সরকারের উচিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল লক্ষ্য দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং এ খাতে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যয় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। ইউএইচসি’র ক্ষেত্রে এসডিজি অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি নিশ্চিত করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব সে বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, নীতি নির্ধারণে যদি ৫ বছর কেটে যায় তাহলে বাকী ১৩ বছরে গোটা দেশে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। আর তাই আগামী দিনগুলোতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে বাংলাদেশেও ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ নিশ্চিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যখাতে এ বছর ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যায়ের মাথাপিছু ৩৭ ডলার খরচ হচ্ছে বলে সরকারিভাবে বলা হচ্ছে। সে ব্যয়েরও সঠিক ব্যবহার নেই। অথচ প্রয়োজন ৬০ দশমিক ৫ ডলার। তাই বাধ্য হয়েই মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সেবা নিচ্ছে। আবার এ ব্যায় বেশি হওয়ার কারণে ৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে।

জানা গেছে, ২০১১ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্ব^লির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’র উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ টাঙ্গাইল জেলার ৩টি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিক্স ইউনিট। তিন বছরের জন্য এ প্রকল্প পরিচালিত হওয়ার কথা। এ পাইলট প্রকল্পের সফলতা বা ব্যর্থতার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। সেক্ষেত্রে ওই কর্মসূচি শেষ হতে এখনো দু’বছর বাকী। অর্থাৎ ইউএইচসি কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও দু’বছর পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

http://www.dailysangram.com/post/363275