১৯ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১১:২৩

মানুষের মন বড় অমূল্য ধন

ভারতের নাগপুর থেকে বেরহম পুলিশের একটি বেরসিকতার খবর দিয়েছে বিবিসি বাংলা এবং এনডিটিভি। সামান্য রসবোধ কিংবা রোমান্টিকতা থাকলে নাগপুর পুলিশ এমনটি করতে পারতো বলে মনে হয় না।

আমাদের সমাজে কতকিছুইতো চুরি যায় হররোজ। যেমন ধরুন, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে গয়নাগাটি, নগদ টাকাকড়ি, গাড়িঘোড়া ইত্যাদি সবই চুরি যায়। থানায় মামলাও হয় এসব চুরি হবার অভিযোগে। এমনকি বিয়ে করা বউও কিন্তু চুরি হয়ে যায় অনেকের কখনও-সখনও। শুধু তাই নয়, কারুর কারুর প্রিয় স্বামীধনও চুরি করে পালিয়ে যান কোনও কোনও চতুর রমণী। কী যান না?

হ্যাঁ, যেসব বস্তুর আকার-আকৃতি, ভর, আয়তন, গঠন ইত্যাদি আছে সেসব বস্তু বা প্রাণি চুরি হতেই পারে। হয়ও। এর পেছনে যেটা কাজ করে তার নাম লোভ, মোহ, লালসা। এসবকিছু যার প্রবল সে যেকোনও সময় প্রবৃত্তির তাড়নায় চুরির সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে। আর চুরি করলে ধরা খাওয়াও অসম্ভব কিছু না। কথায় আছে, ‘১০ দিন চোরেরতো একদিন গৃহস্থের।’ অর্থাৎ চোর ১০ দিন চুরি করলে একদিন ধরা তাকে পড়তেই হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

আমাদের সমাজে কত বিচিত্র রকমের চুরির ঘটনা ঘটে যায় তার ইয়ত্তা নেই। পোষা কুকুর, বেড়াল, পাখি, এমনকি শিশুসহ তাদের খেলনা পুতুলচুরির মামলাও যায় থানা-পুলিশের কাছে। এসব নিয়ে তুলকালাম কা- পর্যন্ত ঘটতে দেখা যায় অনেক সময়।

আগে নাগপুরের ঘটনাটাই বলি: এটা একেবারে অন্যরকম চুরি। সম্প্রতি নাগপুরের এক যুবক ‘তাঁর চুরি যাওয়া মন খুঁজে দিতে’ পুলিশের সাহায্য চেয়ে বিফল হয়েছেন। এক রমণী তাঁর ‘মন চুরি করেছেন’ জানিয়ে তা উদ্ধার করে দিতে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন যুবকটি। অভিযোগের কথা শুনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে অভিযোগ না নিয়েই হতোদ্যম যুবকটিকে ফিরিয়ে দেন।

চুরির অভিযোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যাওয়া এ যুবকের কাহিনীটি এক অনুষ্ঠানে শুনিয়েছেন নাগপুর পুলিশের কমিশনার শ্রী ভুষণকুমার উপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, যুবকের অভিযোগের কথা শুনে ‘বেকুব বনে যাওয়া’ ওসি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। অবশ্য ভারতীয় আইনে মনচুরি বা হৃদয়হরণের অভিযোগ নেয়া যেতে পারে এমন কোনও ধারা নেই। —ইত্তেফাক, ১০-০১-২০১৯।

মানুষের হাত কেটে নিলে বা ভেঙে দিলে মামলা হয়। দেহের কোনও অংশ আহত করলে মামলা করা যায়। কিন্তু মন বা হৃদয় কেউ নিয়ে গেলে মামলা হবে না। থানা-পুলিশ কিংবা কোর্টের কিছু করণীয় থাকবে না, তা কী করে সম্ভব?

মন বলে কিছু বাহ্যত দৃশ্যমান না থাকলেও এ নিয়ে অনেক কিছুই আছে। যেমন: মন নিয়ে বা মন বিষয়ক হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অসংখ্য ও অগণিত গান, কবিতা এসব না হয় বাদই থাক। কিন্তু মন সম্পর্কে যেসব গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়েছে তার কি কেউ হিসেব করেছেন? নিশ্চয়ই না। মনোবিজ্ঞান বা সাইকোলজি নামে একটা বিষয় আছে। এটি বিশ্বের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। পৃথিবীতে লাখ লাখ শিক্ষক আছেন যারা এ বিষয়ে পড়ান। লাখ লাখ শিক্ষক থাকলে তাঁদের ছাত্রও আছেন কোটি কোটি। বিশ্বে মনোচিকিৎসকও আছেন লাখ লাখ। তার মানে মনোরোগীও রয়েছেন কোটি কোটি। শুধু মনোরোগ হাসপাতালই আছে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার। শুধু নেই ‘মনোচোর’ বা মন-চোরা গ্রেফতারের জন্য থানা-পুলিশ এবং এমন চৌর্যবৃত্তির শিকার কেউ হলে তার জন্য আইনানুগ বিচারের ব্যবস্থা। আমরা আসলে কোন সভ্যজগতে বসবাস করছি তা কি বলতে পারি?

চোখে দেখা না গেলেও মন বলে একটা যে কিছু আছে তাতো সবাই অনুভব করেন। বোঝেনও। ‘মন-মরা’ লোক নিশ্চয়ই অনেকে দেখেছেন। মনে মনে অর্থাৎ মনের দিক থেকে যেলোক মারা যায় তাকে ‘মন-মরা’ বলা হয়। মন-মরা লোকের চিকিৎসা বড় কঠিন। দেহরোগের চিকিৎসা সহজ হলেও মনোরোগের চিকিৎসা ততটা সহজ কিন্তু নয়। তার মানে মন আছে বলেই মানুষের মনোরোগ হয়। এই মনোরোগের চিকিৎসা যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমন তা ব্যয়বহুলও। কারুর মন সুস্থ না থাকলে পুরো দেহই অকেজো হয়ে যেতে পারে। মন যেমন দেখা যায় না, মনের রোগও সহজে ধরা পড়ে না। তবে মানুষের আচার-আচরণে বা স্বভাব দেখে তার মনোরোগ বোঝা যায়। পরীক্ষানিরীক্ষা করেও মানুষের মনোরোগ শনাক্ত করা সম্ভব।

কথায় বলে, ‘মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান।’ মানবদেহের সব অংশ দেখা গেলেও মন বলে যে অংশ আছে তা অদৃশ্য। এর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু দৃশ্যমান নয়। সত্যি বলতে কী এই অদৃশ্য মনই হচ্ছে মানবদেহের সারাংশ। মন না থাকলে দেহের কোনও মূল্য নেই। অথচ মন কোনওভাবে হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে তা ফিরে পাবার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু মন চুরি হলে শুধু দেহই বেকার হয় না।

অনেকের ঘর-সংসারও বেকার হয়ে পড়ে। সব উচ্ছন্নে যায়। যার মন চুরি হয় তারতো সর্বনাশ হয়ই, পুরো পরিবারটাই ছন্নছাড়া হয়। তাই মন চুরির ঘটনা যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা ভুক্তভোগী এবং তার পরিবার ছাড়া অন্যের বুঝবার কথা নয়।

হ্যাঁ, বলছিলাম মন-চোরাদের পাকড়াওয়ের ব্যবস্থা ভূভারতে নেই। নাগপুরের হতভাগ্য যুবকের মন-চুরি যাবার ঘটনা তারই প্রমাণ। সেখানকার পুলিশ কমিশনারও অকপটে তা স্বীকার করলেন। শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে মন-চোরাদের আইনের আওতায় এনে পাকড়াওয়ের ব্যবস্থা আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই এ বিষয়ে আইন প্রণীত হওয়া খুবই জরুরি।

আর হ্যাঁ, একটা জরুরি বিষয় আমাদের সবার জানা দরকার। সেটা হচ্ছে, হৃদয় ও মনের ফারাক। যদিও হৃদয় এবং মনকে আমরা অনেকই এক অর্থে বুঝি বা ধরি। কিন্তু আসলে তা নয়। যেমন মনের ইংরেজি মাইন্ড। আর হৃদয়ের ইংরেজি হার্ট। মাইন্ড আর হার্ট নিশ্চয়ই এক নয়। ঠিক তো? হার্ট বা হৃদয়ের অস্তিত্ব আছে। প্রাণি হত্যা করলে হার্ট দেখা যায়। ছোঁয়াও যায়। কিন্তু মন দেখা যায় না। ছোঁয়া তো দূরের কথা। তবে মন অনুভব করা যায়। মানুষের মন আছে কি না, তাও টের পাওয়া যায়। মানুষের এই মন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও চুরি যে হয় তা কিন্তু স্বীকার না করে উপায় নেই। হ্যাঁ, এই মন ধরা যায় না।

দেখা যায় না। যায় না স্পর্শ করাও। আর তাই মন-চোরার বিরুদ্ধে কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা এখনও প্রণীত হয়নি। সমস্যাটা এখানেই। এজন্যই নাগপুরের যুবকটি তাঁর চুরি যাওয়া মনের খোঁজ পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন না আইনি সহায়তাও। অথচ মানুষের এই মন বড় অমূল্য ধন।

http://www.dailysangram.com/post/361616