১৭ জানুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:২৪

কথা রাখেননি ব্যবসায়ীরা

চালের দাম কমেনি

সম্প্রতি দেশে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩ থেকে ৭ টাকা। গত বৃহস্পতিবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে ধান ও চাল ব্যবসায়ীরা এক সপ্তাহের মধ্যে দাম কমানোর আশ্বাস দেন। কিন্তু কথা রাখেননি ব্যবসায়ীরা। এক সপ্তাহ পার হলেও চালের দাম কমেনি। সেই চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাড়তি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে সব শ্রেণিপেশার মানুষের।

জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সরকার গঠনের প্রাক্কালে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মনিটরিং জোরদার না থাকার সুযোগে বছরের শুরুতেই চালের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্য ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখাচ্ছেন, অতি বৃষ্টিতে উৎপাদন ঘাটতির পাশাপাশি বোরো মৌসুম প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমন মৌসুমে ধান এলেও সরকার বেশি দামে ধান-চাল কিনছে। এ কারণে বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ধানের দাম বৃদ্ধির ফলে চালের দামও বেড়েছে।

যদিও এখন আমন মৌসুমের পর্যাপ্ত ধান রয়েছে। বাজার পর্যায়ে ধান ও চালের প্রচুর সরবরাহ আছে। ফলে চালের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করেন ক্রেতারা।

বাজারে দাম বৃদ্ধির কয়েক দিনের মধ্যে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। গত ১০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা আশ্বাস দেন চালের দাম কমানো হবে। ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের ভিত্তিতে দুই মন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে যাওয়া চালের দাম কমে আসবে। কিন্তু চালের বাজার আগের মতোই চড়া।

গত সোমবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তার দপ্তরে এ বিষয়ে আলাপকালে সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে চালের দামে প্রভাব পড়েছে। চালের দাম কমবে। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। চাল মজুদ রেখে দাম বাড়ানো হচ্ছে কি-না খুঁজে দেখা হবে। চালের কোনো ঘাটতি নেই। চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। এর পরেও দাম কেন বাড়ল তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এখনও রাজধানীর খুচরা বাজারে চড়া দামেই চাল বিক্রি হচ্ছে। খুচরা চাল বিক্রেতা মিরপুর-১ নম্বর বাজারের জহিরুল ইসলাম, পীরেরবাগের মো. মানিক ও কারওয়ান বাজারের মো. ইউনুস আলী সমকালকে জানান, খুচরায় চালের দাম কমেনি। পাইকারি বাজার থেকে বাড়তি দামে কিনে বিক্রি করতে হচ্ছে।

খুচরা বাজারে এখনও কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়ে যাওয়া সরু চাল মিনিকেট ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা ও নাজিরশাইল ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি চাল বিআর-২৮ আমন মৌসুমের নতুন চাল ৩ টাকা বাড়তি দরে ৪০ থেকে ৪২ টাকা ও বোরো মৌসুমের চাল ৫ টাকা বেড়ে যাওয়া দর ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। মোটা চালে ৪ টাকা বেড়ে স্বর্ণা ৩৮ থেকে ৪০ টাকা ও গুটি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সুগন্ধি চালের কেজিতে ৬ থেকে ৭ টাকা বেড়ে এখন ৯৫ থেকে ১০০ টাকা হয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা ও পাইকারি বাজারে চালের দাম কমাতো দূরের কথা, আরও বেড়েছে। সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে গড়ে ২ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ টাকা। এর মধ্যে মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। পাইকারিতে কেজিপ্রতি স্বর্ণার দাম বেড়েছে ৬ টাকা ৪৫ পয়সা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মাঝারি চাল বিআর-২৮-এর দাম বেড়েছে ৫ টাকা ও মোটা চাল স্বর্ণার দাম ৫ টাকা ২৬ পয়সা বেড়েছে।

পাইকারি চালের আড়ত মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের জাহান রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. শাহ আলম স্বপন সমকালকে বলেন, মিল মালিকরা যে হারে দাম বাড়িয়েছেন সে তুলনায় দাম মোটেই কমাননি। সামান্য দাম কমালেও এখনও কম দামের চাল বাজারে আসেনি। প্রতি বস্তা মিনিকেট চালের দাম ২৫ থেকে ৫০ টাকা কমিয়েছেন। অন্যান্য চাল মিল থেকে বাড়তি দামেই আনতে হচ্ছে। এ মাসের শুরুতে বস্তায় চালের দাম বেড়েছিল ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা।

এ হিসাবে মিল পর্যায়ে শুধু মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা দাম কমেছে। তবে রাইস মিল মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, কেজিতে দুই-এক টাকা কমে মিল থেকে মিনিকেট চাল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা এবং বিআর-২৮ চাল ৪১ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মোটা চালের দাম কেজিতে ৩ টাকা কমেছে।

বাংলাদেশ অটো-মেজর ও হাসকিং রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও রশিদ এগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকারী আবদুর রশিদ সমকালকে বলেন, 'মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে চালের দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছিলাম। সে অনুযায়ী মিল পর্যায়ে সব চালের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে না কমলে সে ক্ষেত্রে মনিটরিং জোরদার করা উচিত।' তিনি দাবি করেন, নির্বাচনের আগে হঠাৎ বাজারে চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ধানের চাহিদা বেড়ে যায়। বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় মিলগুলোতে চালের দাম সামান্য বাড়ানো হয়। কিন্তু খুচরায় তুলনামূলক অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন বাজারে চালের চাহিদা স্বাভাবিক হয়েছে। ধানের দামও কমছে। তাই মিলগুলোতে চালের দামও কমানো হয়েছে বলে তিনি জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চাল উৎপাদন বেড়েছে। গত মৌসুমে আমন চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৫৬ হাজার টন। এবার উৎপাদন আরও বেশি হবে। গত মৌসুমে বোরো চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার টন ও আউশ চাল উৎপাদন হয়েছে ২৭ লাখ টন। তিন মৌসুমে চালের উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৫৯ লাখ টন, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদামে চালের মজুদ রয়েছে ১২ লাখ ২৯ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার টন। ২০১৭ সালে বন্যায় হাওরে ফসল নষ্ট হওয়ায় সরকারি হিসাবে ৯ লাখ টন ঘাটতি ছিল। তখন ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল ২০ লাখ টন উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে আমদানিতে শুল্ক্ক কমানোয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় ৩৯ লাখ টন। এদিকে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে চাল আমদানিতে ২৮ শতাংশ শুল্ক্ক ও কর পুনরায় আরোপ করা হয়। যাতে কৃষকদের ধান-চালের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হয়। তখন এক দফায় ব্যবসায়ীরা মোটা চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বাড়িয়েছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (সরেজমিন) ড. মো. আবদুল মুঈদ সমকালকে বলেন, কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্যে কেনাবেচা হওয়া প্রয়োজন। যাতে কৃষকরা উৎপাদন খরচ পান। তারা যৌক্তিক দাম না পেলে আবাদে নিরুৎসাহিত হবেন। আবার বাজারে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হলেও এর সুবিধা কৃষকরা পান না। উল্টো ক্রেতাদের ভোগান্তি বাড়ে। এসব বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো উচিত। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিকেজি ধানের গড় উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা ৩০ পয়সা ও চালের গড় উৎপান খরচ ৩৭ টাকা ৯০ পয়সা। এই হিসাবে যৌক্তিক বাজার দাম হওয়া প্রয়োজন।

কয়েকদিন ধানের দাম কমেছে। এখন কৃষকরা বিক্রি করে স্বর্ণা জাতের ধানে মণপ্রতি ৭৩০, বিআর-২৮ জাতের ধান ৯২০ ও সরু ধানের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা পাচ্ছেন। এ হিসাবে ধানের কেজিতে বর্তমান গড় দাম ২২ টাকা ৮৮ পয়সা। এ দামে ধান বিক্রিতে কৃষকরা প্রতি কেজি ধানে উৎপাদন খরচের চেয়ে গড়ে ২ টাকা ৪৩ পয়সা কম পাচ্ছেন। কৃষকরা কম পেলেও ক্রেতাদের অনেক চড়া দামেই চাল কিনতে হচ্ছে। নানা হাত ঘুরে এর বাড়তি মুনাফা তুলছেন ব্যবসায়ীরা।

https://samakal.com/economics/article/19011129