১৭ জানুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:০১

জাতি অবলোকন করবে

‘যথাযথ’ শব্দটি মানব জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান সময়ে যথাযথ কাজ আমরা ক’জনা করতে পারছি। কোন কাজ যথাযথভাবে তথা ঠিকমতো সম্পন্ন না হলে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয় না। এই বিষয়টি সবাই মৌখিকভাবে স্বীকার করে নিলেও কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় বিপরীত আচরণ। ফলে যথাস্থানে যথা কাজ হয় না, হয় না যথা আচরণও। এতে সমাজে অশান্তির মাত্রাই শুধু বাড়ছে না, হোঁচট খাচ্ছে আমাদের প্রগতির অভিযাত্রাও। উদাহরণ হিসেবে আমরা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কথা তুলে ধরতে পারি। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হবে, তা তো আমাদের কাছে খুবই স্পষ্ট। এ নিয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই, নেই কোন বিতর্কও। এরপরও আমাদের সমাজে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যথাস্থানে নেই। এর কারণ উদঘাটন প্রয়োজন, প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাও। এ নিয়ে অনেক কথা হয় কিন্তু গবেষণার সঙ্গত কাজটি হয় না। অথচ ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে যথাযথ সম্পর্ক জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১৩ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মুদ্রিত একটি খবরের শিরোনাম ‘ছাত্রলীগ-শিক্ষক সমিতি মুখোমুখি অবস্থানে’। খবরে বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঝোলানো হয়েছিল নৌকা প্রতীকের ফেস্টুন। সম্প্রতি তার পাশেই ক্যাম্পাসে র‌্যাগিংবিরোধী ফেস্টুন টাঙ্গায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, যা সরিয়ে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে মুঠোফোনে এক শিক্ষকের সঙ্গে বাগবিত-া হয় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার। এর জেরে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ থেকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে শিক্ষক সমিতি ও ছাত্রলীগ। ১২ জানুয়ারি শনিবার উভয়পক্ষ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। শিক্ষকদের অভিযোগ, গত মঙ্গলবার যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যলয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল কবির জাহিদকে মুঠোফোনে ‘রাজাকার’ বলে অকথ্য ভাষায় গালি ও হুমকি দেন। পাল্টা অভিযোগ করে ছাত্রলীগ বলেছে, ওই শিক্ষক ছাত্রলীগ নিয়ে কটূক্তি ও গালিগালাজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষক ইকবাল কবির বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। অথচ আমাকে রাজাকার বলে ফোনে হুমকি দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। আমি এতে ভীষণভাবে অপমান বোধ করছি। আমি এর বিচার চাই।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১২ জানুয়ারি শনিবার দুপুরে উপাচার্যের সম্মেলনকক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বছর ক্যাম্পাসে র‌্যাগিংবিরোধী পোস্টার-ফেস্টুন টাঙানোর সিদ্ধান্ত হয়।

সম্প্রতি ক্যাম্পাসের পাঁচটি স্থানে ওই পোস্টার ও ফেস্টুন ঝুলিয়ে দেয়া হয়। একটি ফেস্টুন নির্বাচনের জন্য ঝোলানো নৌকা প্রতীকের পাশে রাখা হয়। ছাত্রলীগের কয়েকজন ওই ফেস্টুন ছিঁড়ে দেয়। পরে আনোয়ার হোসেন নামে এক বহিরাগত যুবক (ছাত্রলীগ নেতা) শিক্ষক ইকবাল কবির জাহিদকে মুঠোফোনে হুমকি দেন। শিক্ষকরা নিরাপত্তার দাবিতে মানববন্ধন করতে গেলে হুমায়রা আজমিরার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ শিক্ষকদের কর্মসূচিতে বাধা দেয়। তারা শিক্ষকদের কর্মসূচির মাইক ভেঙ্গে দিয়েছে। কয়েকজন শিক্ষককে তারা ধাক্কাও দিয়েছে, যা শিক্ষকদের জন্য চরম অপমানজনক। উপাচার্য বলেন, এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করা হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। উপাচার্য আরও বলেন, র‌্যাগিংয়ের নামে গত বছর নতুন ভর্তি হওয়া কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে অত্যাচার নির্যাতন করেন জ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এক ছাত্রী ভর্তি বাতিল করে চলে যান। র‌্যাগিংয়ের অপরাধে এক ছাত্রের বিরুদ্ধে গত বছর শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আর কেউ যাতে র‌্যাগিংয়ের শিকার না হন সে জন্য সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে র‌্যাগিংবিরোধী পোস্টার-ফেস্টুন লাগানো হয়।

র‌্যাগিংবিরোধী পোস্টার-ফেস্টুন লাগানোকে কেন্দ্র করে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা যথাযথ বলে বিবেচনা করা যায় না। ছাত্রদের একটি অংশের আচরণ থেকে মনে হয়েছে তারা ছাত্র কম, রাজনীতিবিদ বেশি। কিন্তু রাজনীতি করতে গেলেও তো বিবেচনাবোধ থাকতে হয়। নির্বাচনী পোস্টার-ফেস্টুন তো সারাবছর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার কথা নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের র‌্যাগিংবিরোধী পোস্টার নির্বাচনী পোস্টারের পাশে থাকাতো কোন অবৈধ বিষয় নয়। কিন্তু এ নিয়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাথে যে উগ্র ও অসম্মানজনক আচরণ করেছেন তা মেনে নেয়া যায় না। আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ র‌্যাগিংবিরোধী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা যথাযথ হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সে ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। সেটাই হবে যথাযথ আচরণ।

তবে যথাযথ আচরণ খুব কম ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে মানুষ বিস্মিত হয়েছে। ফলে চলছে বিচার-বিশ্লেষণ। এই ধারা হয়তো আরো অনেক দিন অব্যাহত থাকবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থীরা বলেছেন, নজিরবিহীন ভুয়া ভোটের এই নির্বাচনে আগের রাতেই আওয়ামী লীগ জিতেছে। নির্বাচনের দিন ভোটাররা প্রতারিত ও অপমানিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসন একযোগে আওয়ামী লীগকে জেতাতে কাজ করেছে।

১১ জানুয়ারি শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বাম গণতান্ত্রিক জোট আয়োজিত ‘ভোট ডাকাতি, জবরদখল ও অনিয়মের নানা চিত্র’ শীর্ষক গণশুনানিতে ওইসব কথা বলেন বাম দলগুলোর প্রার্থীরা। দিনব্যাপী গণশুনানিতে ৮২ জন প্রার্থী তাদের অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ তুলে ধরেন। এর মধ্যে কয়েকজন বলেছেন, এটি ছিল এক কলঙ্কিত নির্বাচন। উল্লেখ্য যে, ১৩১ আসনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ১৪৭ জন প্রার্থী অংশ নেন। ১২ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় গণশুনানি সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি মুদ্রিত হয়।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবারের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১২ আসন থেকে কোদাল প্রতীকে দাঁড়ান। গণশুনানিতে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন রাতেই কেন্দ্রভেদে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা যারা ভোট দিতে গিয়েছিলাম, দেখেছি একটা ভোট কেন্দ্রে ভোটারের তেমন কোন ভিড় নেই, অথচ নয়টা বা সাড়ে নয়টার মধ্যেই ব্যালট বাক্স ভরে গেছে।’ জোনায়েদ সাকি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এর মতো কলঙ্কজনক নির্বাচন আর নেই। এটা আমাদের উপলব্ধি করার কথা। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন হলো, কিন্তু সেই নির্বাচনে জনগণকে অংশ নিতে দেওয়া হলো না। সম্পূর্ণভাবে প্রশাসনের কর্তৃত্ব কাজ করেছে।’ নরসিংদী-৪ আসনে কাঁস্তে প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন সিপিবির কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় একটি ভোট কেন্দ্রের এক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নির্বাচনের আগের দিন আমার কাছে স্বীকার করেন, প্রশাসনের নির্দেশ ৩৫ শতাংশ ভোটের সিল যেন নির্বাচনের আগের রাতেই দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের চাপে পড়ে তা ৪৫ শতাংশ হয়ে যায়। সেই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নির্বাচনের আগের দিন রাতে আমাকে বলেছিলেন, এখন আমি কীভাবে এই বাড়তিটুকু ম্যানেজ করবো।’

গণশুনানি অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সব প্রার্থীর কথাই রেকর্ড করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ বাতিল করার দাবি জানিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা বলেছেন, গণশুনানির তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বিনিময় করা হবে। জোট এসব তথ্য নিয়ে নিজেদের সভায় আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে। হতাশ ও অপমানিত দেশবাসীকে সাহস যোগাতে তারা দলনিরপেক্ষ তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন জোরদার করবেন।

গণশুনানি অনুষ্ঠানে যে তথ্য ও অভিজ্ঞতা পেশ করা হলো তা বিস্ময়কর। এতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে ওইসব তথ্য ও অভিযোগের যথার্থতা প্রমাণে প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠ তদন্ত। কেউ কেউ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও বলেছেন। নির্বাচন কমিশনের কাছেও অভিযোগ পেশ করা হয়েছে।

উপলব্ধি করা যায় যে, সামনের দিনগুলোতে তদন্ত ও আইনি লড়াইটার পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মসূচিও অব্যাহত থাকবে। এমন বাতাবরণে সরকারের এবং বিরোধী দলের ভূমিকা জাতি গুরুত্বের সাথে অবলোকন করবে। ন্যায় এবং সত্যের বিজয় আমাদের কাম্য।

http://www.dailysangram.com/post/361404