ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। ছবিটি ঢাকা শিশু হাসপাতাল থেকে তোলা
১৬ জানুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ৮:৫৬

ঠাণ্ডাজনিত রোগ জটিল চক্রে

শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের ভয় নিপাহ ভাইরাস নিয়ে। এনসেফালাইটিসের উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষায় ধরা পড়ছে না এই ভাইরাস। অন্যদিকে শ্বাসতন্ত্রের রোগে বাড়ছে জটিলতা। ওষুধে কাজ হচ্ছে না বা আগের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। ডায়রিয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা বেড়েছে। খাবার স্যালাইন কিংবা প্রচলিত ওষুধে সহজে কমছে না। উপরন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নানা উপসর্গ। আগে শুধু বয়স্কদের মধ্যে বাত রোগ এবং হাত-পা ও হাড় জোড়ায় ব্যথার প্রকোপ বেশি ছিল। এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোরদের মধ্যেও। নিউমোনিয়ায়ও বেড়েছে ভোগান্তি। এসব মিলে চলতি শীত মৌসুমে এসব রোগের ধরন ও গতি-প্রকৃতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই। ঢাকার মহাখালীতে আইসিডিডিআর,বির কলেরা হাসপাতাল ও শেরেবাংলানগরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর ভিড়। মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালেও একই চিত্র। বেড়ে গেছে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগী।

বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী সোলায়মান কবির সোমবার সকাল সোয়া ৯টায় ঢাকা শিশু হাসপাতালে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন দুই বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে। কী হয়েছে জানতে চাইলে বললেন, ‘রাত থেকে ছেলেটার হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট আর পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। তাই এখানে নিয়ে এলাম।’

সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় নতুন ও পুরনো উভয় ভবনেই রোগীর ভিড়। পুরনো ভবনের আউটডোরের সামনে রিকশা থেকে ছেলের হাত ধরে নামেন ৬৫ বছরের সালেহা পারভীন। জানতে চাইলে বললেন, ‘আগে থেকেই অ্যাজমার সমস্যা ছিল। দুই দিন ধরে আর যেন টিকতে পারছি না। আগে যে ওষুধ ব্যবহার করতাম তাতে কাজ হচ্ছে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক দিন ধরে শীতের সঙ্গে ঝিরঝিরে শীতল বাতাসের প্রভাবে দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকায়ও মৌসুমি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও বয়স্ক মানুষ। ফলে সতর্ক থাকাটা জরুরি।

রোগ বিজ্ঞানী ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপীই এনসেফালাইটিসের কারণ উদ্ঘাটনে হিমশিম অবস্থা। কোথাও ৫০ শতাংশের বেশি কারণ জানা যায় না। আর বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৪-১৫ শতাংশ কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়। ফলে বিষয়টি অনেকটাই জটিল। জাপানিজ এনসেফালাইটিসও আছে এ দেশে। এ ছাড়া ডায়রিয়া ও কলেরার ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। বিশেষ করে শীতকালে বেশি ডায়রিয়া হচ্ছে শিশুদের। এ ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাসই বেশি দায়ী। আছে কলেরার প্রকোপও। আর তা সারতে সময় নেয় বেশি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, এবার ১ নভেম্বর থেকে চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত এনসেফালাইটিসের উপসর্গ ধরা পড়েছে ১৩০ জনের শরীরে। এ ছাড়া ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ছয় হাজার ৩৮৫ জন, এআরআইয়ে পাঁচ হাজার ৬০৯ জন, সিওপিডিতে ৫১৪ জন এবং শীতজনিত অন্যান্য রোগে ছয় হাজার ৫০৫ জন।

অবশ্য এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবের গরমিল থাকার চিত্র ফুটে উঠেছে আইসিডিডিআর,বির তথ্য থেকে। ১ থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪ দিনে শুধু ওই একটি হাসপাতালেই ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল সাত হাজার ৫৬জন। তিন দিন ধরে তা বেড়েই চলেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, শীতের সময় বরাবরই ঠাণ্ডাজনিত জ্বর, সর্দি, কাশি, হাঁপানি, গিঁটে বাতের ব্যথার মতো কিছু রোগ দেখা দেয়। প্রচলিত কিছু ওষুধেই আবার তা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এসবের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। অনেক উপসর্গেই পরিবর্তন আসছে। আবার আগে সেব ওষুধের সহজে কাজ হতো এখন সেগুলোতে কাজ হয় না। কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতাও আগের মতো নেই।

জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন এলাকা থেকে নিপাহ ফাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গের ঘটনা পেয়েছি। তবে আক্রান্তদের শরীরের নমুনা পরীক্ষা করে তাতে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। যারা এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত হয়েছে তাদের শরীরে নিপাহ মেলেনি। তবে এর পরও আমরা বসে নেই। নিপাহ প্রতিরোধে কর্মকৌশল ঠিক করছি।’

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সাহেদুর রহমান খান বলেন, এবার শ্বাসতন্ত্রের রোগের প্যাটার্নে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে যেমন ঠাণ্ডাজনিত সংক্রমণ বা ভাইরাস জ্বরের সঙ্গে সর্দি, কফযুক্ত কাশির প্রকোপ বেশি থাকত, এবার অনেক রোগী আসছে যাদের জ্বর-সর্দি বেশি থাকছে না। তবে শুকনো কাশির প্রকোপ বেশি। অন্যদিকে ওই কাশি কমতে সময়ও নিচ্ছে অনেক বেশি। সাধারণ ওষুধের কার্যকারিতায়ও হেরফের দেখা যাচ্ছে। বেশিদিন ওষুধ নিতে হচ্ছে। সব মিলে বলা যায় জটিলতা বেড়ে গেছে, যা উদ্বেগের।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, ঠাণ্ডাজনিত রোগে রোগে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে, যাতে শিশুদের ঠাণ্ডা না লাগে। আর কোনো সমস্যা মনে হলেই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতাল ইউনিটের প্রধান ডা. আজাহারুল ইসলাম খান বলেন, ‘ডায়রিয়া আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে।’ তবে অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, ‘রোটা ভাইরাসের সঙ্গে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। এটায় জটিলতার ধরনে পরিবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক।’

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত খেজুর গাছে হাঁড়ি পেতে রাখার পর ভাইরাসবাহী বাদুড় রস খেতে গিয়ে হাঁড়িতে নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়। ওই কাঁচা রস কোনো মানুষ পান করলে তার রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এমনকি খুব বেশি মাত্রার তাপে ওই রস জ্বাল না দিলে তাতে ওই ভাইরাস টিকে থাকতে পারে। কাঁচা খেজুর রস পান করার সাত-আট দিনের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা দেয়।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2019/01/16/726396