১৬ জানুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ৮:৫৫

কুয়েতের শ্রমবাজারে কালো থাবা

১৫ কোম্পানি কালো তালিকাভুক্ত : চরম শ্রমিক অসন্তোষ

তেল সমৃদ্ধ দেশ কুয়েতের শ্রমবাজারে কালো থাবা পড়েছে। দেশটিতে তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করছে। কতিপয় অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সীর মাধ্যমে নিরীহ কর্মীরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে ফ্রি ভিসায় কুয়েতে গিয়ে কাজ ও বেতন-ভাতা না পেয়ে অনাহার-অনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছে। বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ না করা এবং কাজের নিশ্চয়তা দিতে না পারায় কুয়েতের ১৫টি কোম্পানীকে দেশটির সরকার কালো তালিকাভূক্ত করেছে।

এদিকে, বিএমইটি কর্তৃপক্ষ কুয়েতের বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুতে ধীরগতি নীতি অনুসরণ করায় শত শত কুয়েত গমনেচ্ছু কর্মীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হবার দুই এক দিন আগে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র ইস্যু করায় দালাল চক্রের টু-পাইস কামানোর পথকে উন্মুক্ত করছে বলেও অভিযোগ উঠছে। ঢাকাস্থ কুয়েত দূতাবাসেও কর্মী নিয়োগের ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রেও নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, পাঁচ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হট সার্ভিসের নামে যখন-তখন পাসপোর্ট জমা ও সরবরাহের জন্য ভিসা ফি’র ৬ হাজার টাকা ছাড়াও অতিরিক্ত দেড়শ’ মার্কিন ডলার বকশিস নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

পাঁচ সিন্ডেকেটের মাধ্যমে হট সার্ভিসের প্রক্রিয়ায় ভিসা নিতে অতিরিক্ত দেড়শ’ মার্কিন ডলার ঘুষ নেয়া অভিযোগ প্রসঙ্গে কুয়েত দূতাবাসের মেসেঞ্জার জাহাঙ্গীর রাতে ইনকিলাবকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। এটা ভিসা সেকশনের কাজ। ঐ সেকশনের কর্মকর্তারা এ বিষয়টি বলতে পারবে। ফকিরাপুলের একটি রিক্রুটিং এজেন্সীর স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসবি ইন্টারন্যাশনাল, টাইমস এভিয়েশন, চট্টগ্রমা ট্রাভেলসসহ আরো একটি এজেন্সী ভিসা ইস্যুর জন্য পাসপোর্ট জমা দিচ্ছে। এই চ্যানেলে কুয়েতের ভিসা পেতে বিভিন্ন শর্তসমূহ শিথিল করা হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়গুলো কুয়েত দূতাবাসের কর্তৃপক্ষের নজরে দেয়া হলেও তা’ আমলে নেয়া হচ্ছে না বলেও ঐ এজেন্সীর স্বত্বাধিকারী উল্লেখ করেন। কুয়েত রাষ্ট্রদূত আদেল মোহাম্মদ এ এইচ হায়াতকে ভিসা ইস্যু নিয়ে অনিয়মের বিষয়গুলো তুলে ধরতে কেউ সাহস পাচ্ছে না বলেও তিনি জানান। সোহাগ এয়ারের স্বত্বাধিকারী জাফর জানান, তার একজন কুয়েতগামী কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র পেতে বিলম্ব হওয়ায় ভিসার মেয়াদ শেষ হতে এক দিন বাকি থাকায় প্রায় ৪২ হাজার টাকা ব্যয় করে বিমানের টিকিট কিনে কর্মীকে কুয়েত পাঠাতে হয়েছে। তিনি বলেন, কুয়েতের শ্রমবাজার ধরে রাখতে বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুর বিষয়টি দ্রুততর করার দাবী জানান।

আটাব মহাসচিব আব্দুস সালাম আরেফ কুয়েত গমনেচ্ছু কর্মীদের বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুতে মন্থরগতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিএমইটি থেকে কুয়েতে কর্মী নিয়োগের বর্হিগমন ছাড়পত্র পেতে কর্মীদের গলদঘর্ম পোহাতে হচ্ছে। এতে কুয়েত গমনেচ্ছু কর্মীদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুয়েতের কিছু কোম্পানীতে সংকট সৃষ্টির কারণে অন্যান্য এজেন্সীর শত শত কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র ভিসার মেয়াদ শেষ হবার দুই এক দিন আগে দেয়ায় কর্মীরা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। এতে অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যাবে। আটাব মহাসচিব কুয়েত গমনেচ্ছু কর্মীদের বর্হিগমন ছাড়পত্র দ্রুত ইস্যু করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

আগামী ২৪ জানুয়ারী কুয়েতের নিয়োগের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এমন পাসপোর্ট গত ৮ জানুয়ারী দূতাবাসে জমা নেয়া হয়েছে। আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারী ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এমন পাসপোর্ট গত ১৩ জানুয়ারী দূতাবাসে জমা নেয়া হয়েছে। আগামী ২৮ ও ২৯ জানুয়ারী ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এমন পাসপোর্ট গতকাল মঙ্গলবার কুয়েত দূতাবাসে জমা নেয়া হয়েছে। উল্লেখিত পাসপোর্টগুলোতে এখনো স্ট্যাপিং লাগেনি। হজযাত্রী পরিবহনে কুয়েত এয়ারলাইন্সকে সুযোগ দেয়া না হওয়ায় বিমানের টিকিট দিয়ে কুয়েত গমনেচ্ছুদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভিসা দেয়া হয় না।

কুয়েত সরকারের প্রকৃত অনুমোদন তথ্য গোপন করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শত শত কর্মীকে কুয়েতে পাঠিয়েছে দালাল চক্র। দীর্ঘ দিন কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকার পর দেশটিতে কয়েক মাস আগে কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। কোন রিক্রুটিং এজেন্সী এসব জালিয়াতির সাথে জড়িত তা এখনো খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। কাজের নিশ্চয়তা ও বেতন-ভাতার দাবিতে কুয়েতের পাঁচটি কোম্পানীতে বাংলাদেশী কর্মীরা চরম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা দেশটিতে বেআইনীভাবে শ্রমিক ধর্মঘট পালন করে। বিষয়টি কুয়েত সরকারের গোচরীভূত হওয়ায় দেশটির আইন শৃংখলা বাহিনী একজন কুয়েতী নাগরিক ও তার সহযোগি দুইজন বাংলাদেশী দালালকে গ্রেফতার করেছে।

কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) আব্দুল লতিফ খান গত ২৮ নভেম্বর এক চিঠিতে বিএমইটি’র মহাপরিচালক সেলিম রেজাকে যে পাঁচটি কুয়েতী কোম্পানী কালো তালিকাভূক্তকরনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে তা’ হচ্ছে, আল খবরা লজিষ্টিক কোম্পানী, কর্টেজ জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানী, ব্লগার্ড ট্রেডিং কোম্পানী, লুলু জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানী ও গোল্ডেন এওয়ার্ড ক্লিনিং কোম্পানী। এছাড়া কালো তালিকাভূক্ত অন্যান্য কোম্পানীগুলো হচ্ছে, শাহ আল গাবরিয়া, মার্কাস সুলতান, ওয়েল আল নসিব, ফজর আল খালিজ, আল কুদ, কেয়ার সার্ভিস, আল আহালিয়া, আল তোয়েক, আল-তাওবাদ ও গ্রীন লজিষ্টিক কোম্পানী। কাউন্সেলর (শ্রম) আব্দুল লতিফ খান প্রতারণামূলকভাবে কুয়েতে কর্মী প্রেরণকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা গত ২ জানুয়ারী এক চিঠিকে কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে কুয়েতে শ্রমবাজার নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনকল্পে সাত দিনের মধ্যে মতামত জানাতে অনুরোধ জানিয়েছেন। কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস এখনো কোনো মতামত জানায়নি।

https://www.dailyinqilab.com/article/179481