১৬ জানুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ৮:৪৪

স্বদেশ ভাবনা

গণতন্ত্র সূচকে আমরা পিছিয়ে কেন?

আবদুল লতিফ মন্ডল

যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) সম্প্রতি ‘Democracy Index 2018’ তথা গণতন্ত্র সূচক ২০১৮ প্রকাশ করেছে।

১৬৫টি স্বাধীন দেশ এবং দুটি অঞ্চল নিয়ে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার- এ পাঁচ মানদণ্ডে একটি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ পয়েন্ট ভিত্তিক এ সূচক তৈরি করে ইআইইউ। সূচকে প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে ইআইইউ দেশগুলোকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে।

এগুলো হল- পূর্ণ গণতন্ত্র (full democracy), ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (flawed democracy), মিশ্র শাসন (hybrid regime) ও স্বৈরতন্ত্র (authoritarian regime)। মূল্যায়নের ১০ পয়েন্টের মধ্যে ৯ দশমিক ৮৭ স্কোর নিয়ে তালিকার শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। শীর্ষ পাঁচে অবস্থানকারী অন্য দেশগুলো হল- আইসল্যান্ড (৯ দশমিক ৫৮ স্কোর নিয়ে ২য়), সুইডেন (৯ দশমিক ৩৯ স্কোর নিয়ে ৩য়), নিউজিল্যান্ড (৯ দশমিক ২৬ স্কোর নিয়ে ৪র্থ) ও ডেনমার্ক (৯ দশমিক ২২ স্কোর নিয়ে ৫ম)।

আর ১ দশমিক ০৮ স্কোর নিয়ে সবার নিচে অর্থাৎ ১৬৭তম অবস্থানে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। এর আগে ক্রমান্বয়ে সিরিয়া (১ দশমিক ৪৩ স্কোর নিয়ে ১৬৬তম), গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো (১ দশমিক ৪৯ স্কোর নিয়ে ১৬৫তম, সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (১ দশমিক ৫২ স্কোর নিয়ে ১৬৪তম) ও চাদ (১ দশমিক ৬১ স্কোর নিয়ে ৬৩তম)।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ভারত, ৭ দশমিক ২৩ স্কোর নিয়ে দেশটির অবস্থান ৪১তম। ভারতের পরে ৬ দশমিক ১৯ স্কোর নিয়ে শ্রীলংকা আছে ৭১তম স্থানে।

বাংলাদেশ ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর নিয়ে ৮৮তম অবস্থানে রয়েছে। অবশ্য গতবার ৫ দশমিক ৪৩ স্কোর নিয়ে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯২তম। ২০১৬ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল ৮৪তম।

ইআইইউ ২০০৬ সালে গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশ শুরু করে। সে বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল ৬ দশমিক ১১ এবং এটি গত ১১ বছরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর।

এর অর্থ দাঁড়ায়, ২০০৬ সালের তুলনায় বাংলাদেশ গণতন্ত্র সূচকে অনেক দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। গণতন্ত্রের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের এত পেছনে পড়ার কারণ এবং কীভাবে অবস্থানের উন্নতি করা যেতে পারে, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত ‘গণতন্ত্র সূচক ২০১৮’- এ ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক’ কিংবা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা মিশ্র শাসন তালিকায় দেশটির অবস্থান।

এর কারণ খুঁজতে বেশি কষ্ট করার দরকার হয় না। যে পাঁচটি মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে সূচক তৈরি করা হয়েছে, তার প্রথমটি হল নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান। স্বাধীনতার পর থেকেই এ মানদণ্ডে বাংলাদেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার যে চারটি মূলনীতি নির্ধারিত হয় সেগুলোর একটি হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের অন্যতম প্রধান শর্ত হল সুষ্ঠু নির্বাচন- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার শুরুতেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার তিন বছর পার হতে না হতেই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থলে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নব্বইয়ের দশকে প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সংসদ নির্বাচন ছাড়া স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এবং এ সময়কালে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে কোনো ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়নি।

আওয়ামী লীগ আমলে ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ, বিএনপি আমলে ১৯৭৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় পার্টির সময়কালে ১৯৮৬-এর ৭ মে ও ১৯৮৮-এর ৩ মে, বিএনপি আমলে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগ সময়কালে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনগুলো এর উদাহরণ।

বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অংশগ্রহণহীন দশম সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ গণতন্ত্রকে ভীষণভাবে দুর্বল করেছে।

দশম সংসদ নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি (২০১৪) দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পচে গেছে। শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, দশম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনেও পেশিশক্তি ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে জয় নিশ্চিত করা হয়। গত বছর মার্চে জার্মান গবেষণা সংস্থা ‘ব্যাটেলসম্যান স্টিফটাং’ কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারকে বিশ্বের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর কাতারভুক্ত করা হয়।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এগুলোর সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও বড় দুটি দলের মধ্যে যে দলটি এসব নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে, সে দল কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের হুমকি, হরতাল-অবরোধ, সংসদ থেকে ওয়াকআউট, সংসদে অনুপস্থিতি ইত্যাদি কার্যকলাপের আশ্রয় নিয়েছে।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের আশ্রয় নেয়। তাই এসব নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা সরকারগুলোর সময়ে গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদ অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে, যা গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বড় বাধা হয়ে ওঠে।

সরকারে কার্যকারিতা সম্পর্কে বলা যায়, গত এক দশকে সরকার উন্নয়নমূল কাজে তৎপর থাকলেও তারা গণতন্ত্রকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। শাসক দলের যুক্তি ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ শুধু ভ্রান্ত নয়, নিষ্ফলও বটে। এ তত্ত্ব অনুসরণ করে চললে গণতন্ত্র তো পাওয়া যাবেই না, এতে দেশের কোনো টেকসই উন্নয়নও ঘটবে না। নির্ভেজাল গণতন্ত্র অনুসরণ করে যে উন্নয়ন করা যায়, পশ্চিমা দেশগুলো এবং পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালে তার অকাট্য প্রমাণ মেলে।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলতে সাধারণত এমন অবস্থাকে বোঝায়, যখন জনগণ তাদের সমস্যা ও চাহিদা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেগুলোর সমাধানে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

এর অর্থ দাঁড়ায়, একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সার্বিক পাবলিক সেক্টরে বা নিজেদের স্বার্থে ঘটতে যাওয়া সব বিষয়ে মতামত প্রদান এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের অধিকার জনগণের থাকবে। বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে অন্যান্য পর্যায়ে জনস্বার্থবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা চালু রয়েছে। ফলে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের ভূমিকা নেই বললেই চলে। অথচ জনগণের স্বার্থ জড়িত আছে এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সুশাসনের একটি অন্যতম শর্ত।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরুতেই সহিষ্ণুতা, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব দেখা দেয়।

দীর্ঘ ৪৭ বছরে এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রাজনীতির মাঠের শত্র“তা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের, বিশেষ করে বড় দুটি দলের নেতাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। গণতন্ত্রের বিকাশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ভূমিকা অপরিসীম হলেও সে নির্বাচন হয়ে পড়েছে টাকা ও পেশিশক্তিনির্ভর।

আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীরা জাতীয় সংসদের ৭০ শতাংশের বেশি আসনে আসীন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক জরিপ অনুযায়ী, নবম জাতীয় সংসদের ৭০.৬ শতাংশ সদস্যের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার রেকর্ড ছিল। বড় বড় রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব এবং নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের প্রধান কর্তা-ব্যক্তিরা চার দশক ধরে দলের প্রধান। দল আর কোনো যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। দলীয় প্রধানের কাছে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত।

সংবিধান স্বীকৃত জনগণের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আগেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। গত এক দশকে গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

এক্ষেত্রে বড় অভিযোগটি হল, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকার এ জঘন্য অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১৮-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অধিকার হ্রাসের বিপরীতে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।

এ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতেই হবে। গণতন্ত্র সূচকে ‘মিশ্র শাসন’ বা ‘যুনৎরফ ৎবমরসব’ দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে অন্তত ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় আমাদের জায়গা করে নিতে হবে।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ়করণ এবং জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা গড়ে তোলার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়ন হোক। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য স্পেসের নিশ্চয়তা থাক। একই সঙ্গে দেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন স্বীকৃত নাগরিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হোক। জনগণ চায়, তাদের প্রিয় দেশ অদূরভবিষ্যতে গণতন্ত্র সূচকে ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় স্থান পাক।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/133755