১৫ জানুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:৪১

রামেক হাসপাতাল

রক্ষণাবেক্ষণের নামে লুট

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) নতুন ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে প্রায় চার বছর আগে। সেই হিসেবে এখনো নতুন থাকার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানের টাইলস উঠে যাওয়াসহ অন্তত ২৫টি স্থানে দেখা দিয়েছে ফাটল।

এ অবস্থা দেখা দেয় ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে এই ভবনের লিফট সংস্কারসহ নানা সংস্কারকাজের নাম করে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ। এর মধ্যে বেশির ভাগ টাকা ব্যয় করা হয়েছে ইচ্ছামতো। পছন্দের ঠিকাদার ও লোকজন দিয়ে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, শুধু এই ভবন না, এভাবে রামেক হাসপাতালের বিভিন্ন ভবন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের নামে সরকারি টাকা হরিলুটের ফাঁদ পাতা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে যা পাওয়া গেছে, তা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র উঠে এসেছে।

এদিকে রাজশাহী গণপূর্ত দপ্তরের ডিভিশন-২-এর একাধিক সূত্র মতে, এরই মধ্যে রামেক হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণকাজের জন্য আরো প্রায় কোটি টাকার কাজের দরপত্রপ্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। এই কাজ দেওয়া হচ্ছে পছন্দের ঠিকাদারদের। যেসব ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের গোপনে দরপত্রের প্রাক্কলিত মূল্য জানিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ওই ঠিকাদাররা ১০ শতাংশ কম দর দিয়ে কাজ পান।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, এই দপ্তরের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে রামেক হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণকাজের নামে। গত তিন বছরে অন্তত ৩০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করা হয়েছে গত প্রায় দুই বছরে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে গেলে মনে হবে, যেন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি কত দিন। ওয়ার্ডগুলোর বেশির ভাগ দরজা-জানালা ভাঙা। ভবনের ছাদ থেকে খসে পড়ে পলেস্তারা। কোথাও খসে পড়েছে টাইলস। রোগীদের শৌচাগারগুলোর অবস্থা তো আরো ভয়ানক। ওয়ার্ডের পুরনো বেশির ভাগ ফ্যান চলে না সহজে।

গরমের সময় হাসপাতালজুড়ে রোগীদের বাড়ি থেকে আনা শত শত ফ্যান ঘুরতে দেখা যায় ওয়ার্ডগুলোতে। আবার নতুন ভবনসহ পুরনো ভবন মিলে সাতটি লিফটের মধ্যে বেশ কয়েকটি অকেজো হয়ে থাকে বেশির ভাগে সময়। বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে রোগীদের চাহিদামতো এক্স-রে, এমআরআই কাজও ঠিকমতো করা যায় না। আবার হাসপাতালের পয়োনিষ্কাশনের সেপটিক ট্যাংকগুলোও ভরে থাকার কারণে ওয়ার্ডের রোগীরা তীব্র গন্ধে জানালা ঠিকমতো খুলতে পারে না। কিন্তু এই ট্যাংক পরিষ্কারের নামে একেকটি ওয়ার্ড বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে গড়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা করে।

গত শনিবার হাসপাতালের বার্ন ও সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেপটিক ট্যাংক থেকে বের হওয়া তীব্র গন্ধের কারণে নিচতলার দুটি কক্ষের জানালা আটকে দিয়ে রেখেছে রোগীর স্বজনরা। ফলে কক্ষের ভেতরে বাতাস চলাচল করতে না পারায় পোড়া রোগীদের শরীর থেকে বের হওয়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে এই ওয়ার্ডের একজন রোগীর স্বজন আসগর হোসেন বলেন, ‘জানালা খোলার কোনো উপায় নেই। জানালা খুললেই বাইরে থেকে টয়লেটের গন্ধ এসে গোটা ওয়ার্ডের রোগীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। ফলে রাত-দিন জানালা বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। একই অবস্থা ২১, ১৩, ১৪, ২৮, ৬, ৭ নম্বরসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডেও।’

গতকাল ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, এই ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসকের কক্ষটি সংস্কার করা হয়েছে। বাইরের জানালাগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু ভেতরের দরজা-জানালাগুলো এখনো ভাঙাচোরা। ওয়ার্ডের ভেতরের ছাদের ওপরের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। জানতে চাইলে ওই ওয়ার্ডের রোগী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘টয়লেটেও যাওয়া যায় না। কত দিন ধরে এই টয়লেটগুলো সংস্কার করা হয়নি বলা মুশকিল। ছাদ থেকে যেন পলেস্তারা খসে পড়বে গায়ের ওপর। বিদ্যুতের লাইনগুলোও ঠিকমতো কাজ করে না। ভাঙাচোরা সকেটে মোবাইল ফোনও চার্জ দেওয়া যায় না। বাইরে গিয়ে টাকা দিয়ে মোবাইল ফোন চার্জ করে নিয়ে আসতে হয়।’

১৬, ১৭, ১৮সহ অন্যান্য ওয়ার্ডে গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। কিন্তু ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বরসহ কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, পুরনো জানালাগুলো সরিয়ে গ্লাস দিয়ে নতুন জানালা বসানো হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডের ভেতরে তেমন কোনো সংস্কার করা হয়নি।

৮ নম্বর ওয়ার্ডে জানালার কাজ করছিলেন রবিউল ইসলাম নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, এই কাজগুলো করাচ্ছেন হারুন নামের একজন ঠিকাদার। তবে রাজশাহী গণপূর্ত দপ্তর থেকে দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, কাজটি পেয়েছে মেসার্স নুরজাহান এন্টারপ্রাইজ।

১৬ নম্বর ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শুনেছি, এই ওয়ার্ডে রক্ষণাবেক্ষণের নামে কয়েক লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু দেখেন তো, কোথাও কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া আছে কি? এমনকি ওয়ার্ডের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা যেখানে বসে সব সময় দায়িত্ব পালন করেন, তার পাশের টাইলসগুলোও উঠে গেছে।’

একটি সূত্র মতে, রাজশাহী গণপূর্ত দপ্তরের ডিভিশন-২-এর কর্মকর্তাদের মদদে এই অনিয়ম হচ্ছে।

তবে হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণকাজে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন রাজশাহী গণপূর্ত দপ্তরের ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ কান্তা। সব কাজ ঠিকমতো করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

অন্যদিকে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দাবি করেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিল্লুর রহমান।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/priyo-desh/2019/01/15/725912