১৫ জানুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:৩৫

আড়তে চাল, বাজারে কৃত্রিম সংকট

গরিবের মোটা চালে আবারো আগুন জ্বলছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। খেটে খাওয়া মানুষের ক্রয়সীমা অতিক্রম করেছে আগেই। তার উপর আবারো সপ্তাহখানেক ধরে প্রতিদিন বাড়ছে মোটা চালের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চাল কেজিতে ৪-৬ টাকা বেড়েছে। কোয়ালিটি ভেদে গরিবের মোটা চাল ৩৬-৩৮ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছে বাজারে পর্যাপ্ত আমদানি না থাকায় দাম বেড়েছে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।

এদিকে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য মিলারদের দুষলেও মিলাররা বলছে আড়তদাররা চাল গুদামে আটকে রেখে ইচ্ছেমত দাম বৃদ্ধি করেছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর দিনাজপুরের হাতেগোনা কিছু আড়তদাররা এই চাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন উত্তরাঞ্চলের মিলাররা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়া অঞ্চল থেকে জানাযায়, ২০১৬-১৭ মৌসুমে বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ কৃষি অঞ্চলে বোরো আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে। চাল আকারে এর পরিমাণ ১৯ লাখ ৬০৩৫ টেন। চার জেলায় মোট আউশ আবাদ হয়েছিল ৪৩ হাজার ২১৩ হেক্টর জমি। চাল আকারে এর উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৩ টন। দুই মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছে ২০ লাখ ১৮ হাজার ৯৪৮ টন। এই অঞ্চলে মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ৪ লাখ ৬৫ হাজার ১৪৯ জন। এই জনসংখ্যার বার্ষিক চালের চাহিদা ১৪ লাখ ২৩ হাজার ২৬০ টন। শুধুমাত্র বগুড়া কৃষি অঞ্চলেই চলতি মৌসুমে চাল উদ্বৃত্ত হয়েছে ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৬৮৮ টন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে এই পরিমাণ আরো বেড়েছে।

তাহলে এই উদ্বৃত্ত চাল গেলো কোথায়? সাধারণ মানুষের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে অনেক ক্লুই বেরিয়ে এসেছে। বিশেষ করে ছোট ছোট চাল ব্যবসায়ী এবং ছোট মিলারদের কাছে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সাধারণ কৃষকের ঘরে এই মুহূর্তে ধান নেই। তারা বলছে মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা তাদের আশি ভাগ ধান বিক্রি করেছে। এই ধান মৌসুমের শুরুতে কমদামে কিনে ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট গুদামে বস্তাজাত করে রেখেছে। পরে এই ধানগুলো চাল আকারে বর্তমানে আড়তদারদের গুদামে আটকে আছে। তারা কৌশলে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করেছে। ব্যবসায়ীরা আরো বলছে চালেল সংকট হলে পাওয়াই যেত না, টাকা বেশি দিলে কিভাবে পাওয়া যায়? এতেই স্পষ্ট যে, চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে এই সিন্ডিকেট। কথা হয় গাইবান্ধার বোনারপাড়া এলাকার হাসকিং চালকল মালিক মোকছেদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, মাসখানেক আগে চালের দাম অনেক কম ছিল। সেই সময় আড়তদাররা বাজারের প্রায় সব চাল কিনে গুদামজাত করে রেখেছে। এখন বাজারে তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেজিতে ৪-৬টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। তিনি আরো বলেন, চালের বাজার বৃদ্ধিতে মিলারদের হাত নেই।

বগুড়ার চালের খুচরা গোদারপাড়ায় কথা হয় চাল কিনতে আসা রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, ৩২ টাকার চাল ৩৭ টাকায় বাধ্য হয়ে কিনতে হলো। ভোক্তারা বরাবরই ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। বাজার মনিটরিং না থাকায় এভাবে লাগামহীন ভাবে চালের দাম বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে খুচরা চালের আড়তদাররা বলছে চালের বাজার পুরোটাই সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত চাল আছে। তার পরেও দেশের বাইরে থেকে প্রতি নিয়তই চাল দেশের বাজারে আসছে। তার পরেও হাতেগোনা কিছু অসাধু ব্যক্তির কারসাজিতে চালের দাম এখন আকাশচুম্বী।

সব মিলে এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ চরম বিপকে পড়ে আছে। সিন্ডিকেটদের দৌড়াত্ম্য এখনি থামানো না গেলে বাজার পরিস্থিতি আরো অস্বাভাবিক হতে পারে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সরকারি খাদ্যগুদামগুলো চলতি মৌসুমে চাল সংগ্রেহে ব্যর্থ হয়েছে। প্রভাবশালী মিলাররা গেলবার খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ করেনি বলেই চলে। যতটুকু চাল সংগ্রহ হয়েছে তার সবটাই ক্ষুদ্র মিলারদের কাছ থেকে এসেছে। তারা বরাবরেই ধনের দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলে আসছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধানের দাম কোন পক্ষ থেকেই ঠিক রাখা যায় নি। সরকারি খাদ্যগুদামে পর্যাপ্ত চাল না থাকার সুযোগও কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মিল এখন চালু। বাজারেও পর্যপ্ত চালের আমদানি। তার পরেও মোটা চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩৬-৩৮ টাকার বেশি। চালের মূল্য বৃদ্ধি লাগামহীন ভাবে সামনের দিকে যাচ্ছে। কোনো মহল থেকেই সেই লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে না। দিন দিন পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া ঘুরে চালের বাজারে এমন চিত্র দেখা গেছে। এঅঞ্চলের কৃষকরা ধান কাটা শুরু থেকেই বাজারে ধান বিক্রি করছে। বর্তমানে কৃষকের ঘরে ধান নেই। রাঘব বোয়াল স্টক ব্যবসায়ীদের হাতে গুদামজাত হয়ে আছে উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ ধান। স্টক ব্যবসায়ীরা সেই ধান চাল করে উচ্চমূল্যে বাজারে ছাড়ছে। এতে রাতারাতি হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ী হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। অসাধু ব্যক্তিরা দেশের মানুষকে জিম্মি করলেও সরকার তাদের কিছু বলছে না। খুচরা ব্যবসায়ীর অভিযোগ অসাধু স্টক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের আঁতাত আছে।

বগুড়া জেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহ মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশের উৎপাদিত চাল দেশের মধ্যেই আছে। কোথায় আছে সরকার ইচ্ছে করলেই খুঁজে বের করতে পারবে। রাঘব বোয়ালদের সবাই চেনে। তিনি বলেন এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেই বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=154672&cat=10