১৫ জানুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:২৭

ফরাসউদ্দিনের প্রতিবেদন : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া জরুরি

দুই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া উচিত-মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম * দুই বছর আগেই মামলা করা উচিত ছিল -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ * উচ্চপর্যায়ের যারা জড়িত তাদেরও চিহ্নিত করা দরকার-ড. ইফতেখারুজ্জামান

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গাফিলতি, অবহেলা বা অপরাধীদের পরোক্ষ সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে- এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, ড. ফরাসউদ্দিনের প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে, এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা রিজার্ভ চুরিতে সহায়তা করেছেন বা অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরও চিহ্নিত করা দরকার। সিআইডির তদন্তের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ড. ফরাসউদ্দিনের তদন্ত প্রতিবেদন এবং এর সুপারিশের বিষয়ে সোমবার যুগান্তরের কাছে এসব মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যুগান্তরের মাধ্যমে দেশবাসী এই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে পেরেছে।

কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উচিত ছিল এ বিষয়টি জানিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। প্রতিবেদনের সুপারিশ যে বাস্তবায়ন হয়নি, তা এতদিন পর জানা গেল। সোমবার যুগান্তরে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের (ফেড বা এফআরবি) নিউইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০০ কোটি ডলার (প্রায় ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা) অবৈধভাবে স্থানান্তরের চেষ্টা করা হয়।

এর মধ্যে আট কোটি ১০ লাখ এক হাজার ৬২৩ ডলার চুরি করে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) মাকাতি শাখার চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে পাঠায় দুষ্কৃতকারী চক্র।

এ ঘটনার পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ ওই তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। পরে তদন্ত শেষে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর কাছে ওই প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সেটি প্রকাশ করা হয়নি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরাধী চক্রের পরিকল্পনা ছিল ১০০ কোটি ডলার সরানোর। কিন্তু চুরি হয় আট কোটি ১০ লাখ ডলার। রিজার্ভ চুরির ঘটনা ২৪ দিন চাপা ছিল। সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনা অবহিত না করে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান গর্হিত অপরাধ করেছেন।

এমনকি এটি অসদাচরণেরও শামিল। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির আট কর্মকর্তার গাফিলতি, দায়িত্বে অবহেলা ও অসতর্কতাকে দায়ী করা হয়। সুপারিশ করা হয়- অন্তত ছয় কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা যেতে পারে। কিন্তু তারা বহালতবিয়তে আছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, একটা তদন্ত করেছে ফরাসউদ্দিনের কমিটি। আরেকটা তদন্ত করছে সিআইডি। দুটি তদন্তের রিপোর্ট একত্র করে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সুনির্দিষ্ট হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

দুই রিপোর্টের আলোকে জড়িতদের বিরুদ্ধে অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় মিলেও ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে হলে অনেক প্রক্রিয়া আছে। তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করতে হবে। ব্যাখ্যা চাইতে হবে। ইচ্ছে করলেই কাউকে চাকরি থেকে অপসারণ করা যায় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, আমি এই প্রতিবেদনের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হলেও এতে যেসব কর্মকর্তার নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে সিআইডি তদন্ত করে দেখতে পারে।

ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমি যতদূর জানি, ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে ড. আতিউর রহমানের পরিচয় ছিল। ওই দেশের গভর্নর আতিউর রহমানকে বলেছিলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনা ‘ফাঁস’ হলে অপরাধীরা পালাতে পারে।

সে কারণে তিনি বিষয়টি গোপন রেখেছেন বলে মনে হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ড. আতিউর রহমানের সম্পর্ক ভালো ছিল না বলে ফরাসউদ্দিনের প্রতিবেদনে বলা হয়।

এটা ঠিক। দুই বছর আগে সিদ্ধান্ত হয়ে আছে এ ঘটনায় মামলা করবে সরকার। কিন্তু মুহিত সাহেব (সাবেক অর্থমন্ত্রী) সেটি করেননি। এখন শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবু হেনা মুহা. রাজি হাসান বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছেন।

তিনি মামলা করার জন্য একজন আইনজীবী ঠিক করবেন বলে শুনেছি। এই মামলা দুই বছর আগে হলে আমরা হয়তো টাকা পেয়ে যেতাম। এখন মামলার ফাইল হলে টাকা পেয়ে যাব বলে আমি মনে করি।

ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআইও তদন্ত করেছে। তাদের তদন্তে এসেছে, উত্তর কোরিয়ার একটি চক্র বাংলাদেশের এই অর্থ হ্যাকিং করেছে।

চীনা একটি গ্রুপও জড়িত আছে বলে তারা জানতে পেরেছে। এফবিআইয়ের রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি। আর এ মামলাটি আগেই হওয়া উচিত ছিল।

ড. ফরাসউদ্দিনের প্রতিবেদনের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে আজ রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে দেশবাসী জানল। এটি জানাতে বা প্রতিবেদনের আলোকে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল।

তিনি বলেন, আমাদের রিজার্ভের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হল। আমরা ভিক্টিম হলাম। অথচ এ ঘটনায় মামলা করা হল না। ড. ফরাসউদ্দিনের প্রতিবেদনে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের শুধু চাকরিচ্যুতিই নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে সিআইডির কাজ বেড়ে গেল। কারণ তদন্ত প্রতিবেদনে অপরাধের সূত্রগুলো পাওয়া গেছে। এখন সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তদন্ত শেষ করা দরকার। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের পেছনে উপরের স্তরের আরও কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।

সিআইডি এ কাজটি করবে। তদন্তে ঘটনার গভীরে যেতে হবে। রেকর্ড পরিমাণ জালিয়াতির এই ঘটনার এখানেই যে শেষ, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? ফলে তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার সিস্টেম সিকিউরড করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ঢেলে সাজাতে হবে। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে নয়, এ ধরনের হ্যাকিং বা জালিয়াতির ঘটনা দমন করতে এই আইনের প্রয়োগ দরকার। আমি মনে করি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। সে কারণে এটিতে সংশোধন আনতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/133251