১৫ জানুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:২৩

চোরাশিকারী ও পাচারকারীরা বেপরোয়া সুন্দরবনে হরিণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে

পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। থেমে নেই চোরাশিকারী ও পাচারকারীদের অপতৎপরতা। চোরা শিকারীদের কবলে পড়ে মারা পড়ছে অসংখ্য হরিণ। বন বিভাগসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সুন্দরবনের সম্পদ ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় তৎপর থাকলেও ওই চক্রটি বিভিন্ন কৌশলে বনে ঢুকে বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোশত, চামড়া, মাথা পাচার করছে। মাঝে মধ্যে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড বা পুলিশের হাতে পাচারের সময় ধরাও পড়ছে। গত প্রায় দেড় বছরে পূর্ব সুন্দরবন ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন বিভাগ, কোস্ট গার্ড, পুলিশ ১৩টি অভিযানে প্রায় ৫শ’ ১০ কেজি হরিণের গোশত, ৩টি চামড়া, ৬টি মাথা, ৮টি নৌকাসহ বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করছে। এ সময় হরিণ শিকার ও পাচারের অভিযোগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বখ্যাত এ সুন্দবনের স্থলভাগ রয়েছে ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার। তবে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের পর্যটক স্পট হিসেবে খ্যাত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী কটকা, কচিখালী এবং দুবলার চর, আলোর কোল, হিরণ পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বিশেষ করে সকাল ও বিকেলে মায়াবী চিত্রল হরিণের পাল দেখা যায়। যা প্রতি বছর প্রায় অর্ধলাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। ১৯৯৫ সালের এফএও এবং ইউএনডিসি’র কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত পশু শুমারী অনুযায়ী সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ১৯৯৬-৯৭ সালের ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বন্যপ্রাণির উপর এক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সালের আরেক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল একই।

একটি সূত্র জানায়, লন্ডন ভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ ও জুলজিক্যাল সোসাইটির তথ্যমতে, সুন্দরবনে বছরে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি হরিণ শিকারীদের হাতে মারা পড়ে। অপরদিকে বাঘের হামলায়ও প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য হরিণ।

জানা গেছে, সুন্দরবনের আকর্ষণ বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণ শিকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সব সময় সতর্ক থাকলেও চোরা শিকারীরা মাছ বা কাঁকড়ার পাস করে বনে ঢুকে বুলেট, জাল পেতে স্প্রি বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, কলার মধ্যে বড়শি ঝুলিয়ে রাখা এবং চেতনা নাশক ওষুধ দিয়ে নিধন করে বিপুল সংখ্যক হরিণ। শিকার করা হরিণের মাংস, চামড়া পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকা, শহরের এক শ্রেণীর উচ্চভিলাসী মানুষ ও সমাজপতিদের বাসায়। আবার হরিণের ২/৪ কেজি গোশত দিয়ে করা হচ্ছে নানা কাজের তদবীর। কেজি প্রতি এ মাংস ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। হরিণের চামড়ারও কদর রয়েছে যথেষ্ট। একটি চামড়া ৫/৭ হাজার টাকা বিক্রি হয়ে থাকে বলে সূত্র জানায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের পশুর নদীর চিলা এলাকা থেকে গত ৭ জানুয়ারি বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে ৩০ কেজি হরিণের গোশত ও পাচারকারীদের ফেলে যাওয়া একটি নৌকা উদ্ধার করে। তবে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। গত ৩ জানুয়ারি শরণখোলা রেঞ্জের চরখালী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা চরখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪শ’ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করে। এ সময় শিকারীরা গহীন বনে পালিয়ে যায়। গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের গোশত ও একটি নৌকা এবং ৮ ডিসেম্বর দুপুরে শরণখোলা রেঞ্জের শাপলা টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা সিন্দুরবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১০ কেজি হরিণের গোশত ও একটি নৌকা উদ্ধার করে। গত ২২ নবেম্বর রাতে ও ২৩ নবেম্বর বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিম বিভিন্ন এলাকা থেকে দুবলার চরের রাস মেলায় আসা ৫৭ জনকে হরিণ শিকার করার অভিযোগে আটক করে। এদের দু’টি ট্রলারের তল্লাশি চালিয়ে হরিণের মাথা, চামড়া, ৫০ মিটার হরিণ শিকার করার ফাঁদ উদ্ধার করে। তাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা করা হয়েছে।

কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের হারবাড়িয়া টহল দল গত ১১ নবেম্বর বন সংলগ্ন মিরগামারি খাল সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের গোশত, একটি চামড়া, একটি মাথা উদ্ধার করে । গত ৮ জুন ভোরে সুন্দরবন সংলগ্ন হরিণ শিকার ও পাচারকারী জোন হিসাবে পরিচিত চরদুয়ানী এলাকার বলেশ্বর নদীর শাখা নাপিতখালী খাল থেকে শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি কোস্ট গার্ড অভিযান চালিয়ে ২৪০ কেজি হরিণের গোশত, একটি নৌকা উদ্ধার করে। এ সময় পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। গত ১২ মে সন্ধ্যায় ও গভীর রাতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের স্মার্ট টিমের টহল ও জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা শেলার চরের মানিকখালী খাল ও চরদুয়ানীর বলেশ্বর নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ শিকারে ব্যবহৃত এমবি আল-মদিনা-১ নামের একটি কার্গো জাহাজ, ৩০ কেজি হরিণের গোশত, ২৩০টি হরিণ ধরার ফাঁদ ও একটি নৌকা জব্দ করে। হরিণ শিকারের দায়ে দাকোপ উপজেলার আমতলা গ্রামের বিশ্বজিৎ মৃধা, বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের আল-আমিন, গলাচিপা উপজেলার চরকাজল গ্রামের মো. হাসান, একই গ্রামের মো. সুমন, আশাশুনি উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের সাইদ সরকারের বিরুদ্ধে বন বিভাগীয় মামলা হয়েছে।

২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোরে শরণখোলা থানা পুলিশ উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন বকুলতলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের গোশতসহ জাফর তালুকদার (৫০) ও সামছুল ইসলাম রিপন (৪৫) কে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় শরণখোলা থানায় মামলা হয়েছে। একই দিন একই সময় কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন অভিযান চালিয়ে ৪০ কেজি হরিণের গোশত, ৪টি মাথা ও একটি নৌকা জব্দ করে। একই সালের ১৮ আগস্ট শরণখোলা থানা পুলিশ রায়েন্দা-তাফালবাড়ী সড়কের উত্তর কদমতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি হরিণের চামড়াসহ সাদ্দাম (২২) নামে এক পাচারকারীকে গ্রেফতার করে। এ ব্যাপারে শরণখোলা থানায় দুইজনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। একই বছরের ৬ জুলাই সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কাতলার খাল এলাকায় কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৮০ কেজি হরিণের গোশত, একটি চামড়া ও দু’টি মাথা এবং একটি নৌকা উদ্ধার করে। অপরদিকে, একই সালের ৪ জুলাই ভোরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোস্টগার্ড ও বনবিভাগের একটি টহল দল সুন্দরবন সংলগ্ন মানিকখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬০ কেজি হরিণের গোশত ও একটি কাঠের নৌকা উদ্ধার করে। তবে এ দু’টি অভিযানে কোন পাচারকারী বা শিকারীকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় কোস্ট গার্ডের ৫টি স্টেশনের কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ তাদের আওতাধীন এলাকাসমূহে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় প্রতিনিয়ত তাদের টহল অব্যাহত রয়েছে। যে কারণে শিকারী চক্র হরিণ শিকার করলেও শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। চোরাশিকারী ও পাচারকারীরা মাছের পাস নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণসহ বন্যপ্রাণি শিকার করে। তাই হরিণ শিকার প্রতিরোধে বৈঠক করে চোরা শিকারীদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের পাস বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। এ ব্যাপারে স্থানীয় এলাকাবাসী অসচেতন। যার কারণে অভিযানকালে হরিণ শিকারী ও পাচারকারীরা গোশত, চামড়া ও মাথা রেখে পালিয়ে যায়। আমাদের পক্ষ থেকে ক্যাম্পেইং এর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বন্যপ্রাণি রক্ষায় জনসাধারণকে বিভিন্নভাবে অবহিত করা হয়। সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষাসহ আইনী বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ভূমিকায় রয়েছে বন বিভাগ। আমরা তাদের সহায়তা করছি মাত্র।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, সুন্দরবনের হরিণ শিকার ও পাচাররোধে কঠোর নজরদারি রয়েছে। শিকারী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের দায়ের করা মামলায় সম্প্রতি দুইজন হরিণ শিকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। হরিণসহ বন্যপ্রাণি ও বনজ সম্পদ রক্ষায় বনরক্ষীদের পাশাপাশি বন বিভাগের ৪টি স্মার্ট টিম পর্যায়ক্রমে পূর্ব সুন্দরবনে কাজ করছে। তিনি দাবি করেন হরিণ শিকারের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। সুন্দরবন বিশাল এলাকা তাই হরিণ শিকার রোধে সর্ব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।

http://www.dailysangram.com/post/361121