১৪ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৮:১৪

ঢাকার সড়কে মৃত্যু বেড়েছে বাস ও বাইকের কারণে

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা গুচ্ছ গুচ্ছ কর্মসূচি নিলেও দেশের সড়ক নিরাপদ হয়নি। তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদহীন ঢাকার সড়ক। দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, নির্বাচনী ডামাডোলের কারণে তদারকি না থাকায় সড়কে মূলত বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও একই সঙ্গে পথচারীদের যথেচ্ছ চলাচলে সড়কে প্রাণ ঝরছেই।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ঢাকার রাস্তায় নেমে আসার বছর ২০১৮ সাল তথা গত বছর ঢাকায় আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২৬৬টি, গত বছর তা ছিল ২৯২টি। ২০১৭ সালে ঢাকায় দুর্ঘটনায় আহত হয় ৩৫৯ জন, গত বছর তা বেড়ে হয় ৫১৬ জন। অর্থাৎ এক বছরে আহত বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। ২০১৭ সালে ঢাকায় ১২৯ জন পথচারী প্রাণ হারায়। গত বছর সংখ্যাটি ছিল ১১৫ জন। গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে নিহত হয় ২৪ জন। এ হার ২০১৭ সালে ২৩ এবং ২০১৬ সালে ১২ জন ছিল।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দুর্ঘটনার হার আগের বছরের তুলনায় বেশিই ছিল। তিনি আরো বলেন, ঢাকার রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বাস ও মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা বেশি। গত বছর নিহত ও আহতদের ৭০ শতাংশই বাস বা মোটরসাইকেলের আঘাতের শিকার হয়েছে। ট্রাফিক আইন না মেনে রাস্তা পারাপারে হতাহতের হার ৩০ শতাংশ।

সাইফুন নেওয়াজ নিজের গবেষণার আলোকে আরো বলেন, ঢাকায় দুর্ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই ঘটছে সকালের ফাঁকা সড়কে—ভোর ৫টা থেকে ৭টার মধ্যে।

পথচারীরা দৌড়াতে গিয়ে গতিশীল গাড়ির নিচে চাপা পড়ছে বেশি। তিনি বলেন, সারা দেশের মহানগর এলাকায় যত পথচারী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়, তার ৭২ শতাংশই ঢাকা মহানগরীর। মূলত জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করা এবং এগুলো যথাযথ স্থানে না থাকা ও যথেষ্ট সংখ্যক না থাকাই বড় কারণ। দৌড়ে ও হাত উঁচিয়ে অতিগতির গাড়ির সামনে দিয়ে পারাপারের সময় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এ জন্য বিদ্যমান ট্রাফিক আইন অনুসারে জরিমানা ও শাস্তি নিশ্চিত করার হার বাড়াতে হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে পারাপার না হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। এ জন্য ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করা হয়। এ অভিযান মাঝেমধ্যে হয়। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনী কাজে ব্যস্ততার কারণে ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা একটু কম হলেও নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাস স্টপেজ উন্নত করা, মার্কিং করার কাজও করবে ট্রাফিক পুলিশ। এ জন্য ৩৯ সদস্যের কারিগরি টিম পেতে যাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।

গত বছরের জুলাই ও আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে খুদে শিক্ষার্থীরা ঢাকার রাস্তায় টানা ৯ দিন আন্দোলন করে। তারপর গত ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস, ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারসহ ১৭টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার যেসব স্থানে ফুট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে, সেসব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা কিংবা ফুট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাসগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। গতকাল ঢাকার কাকলী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বনানী, শাহবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পথচারী ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে চলাচল করছে না। এসব স্থানে ফুট ওভারব্রিজের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়নি। শাহবাগে তিনটির মধ্যে দুটি ফুট ওভারব্রিজই অপরিচ্ছন্ন। কাকলী ফুট ওভারব্রিজে না উঠে সকাল ১১টায় রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়া রহমান ও আহমেদ কামাল। কেন ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করছেন না জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, উঠতে গেলে ১০ মিনিট নষ্ট হয়ে যাবে। তখন কাকলী মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন নির্বিকার।

জানা গেছে, ট্রাফিক পুলিশ ও সিটি করপোরেশন প্রথম দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেও গত নভেম্বর থেকে তাদের তৎপরতা কমে আসে। তবে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশ আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে।

গত ১৮ আগস্টের মধ্যে ঢাকা শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং ও রোড সাইন দৃশ্যমান করা, অবৈধ পার্কিং ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা, সব সড়কের নামফলক দৃশ্যমান স্থানে সংযোজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে (ডিএসসিসি)। গতকাল ফার্মগেট ও নতুন বাজার সড়কে এসব মার্কিং দেখা গেলেও প্রয়োগ চোখে পড়েনি। গত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকা শহরের সব সড়কের সড়ক বিভাজকের উচ্চতা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। গতকাল শাহবাগ, কাকলীসহ বিভিন্ন স্থানে নির্দেশের বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা জেব্রা ক্রসিং মার্কিং, বাস বে নির্মাণসহ সব ফুট ওভারব্রিজ পরিচ্ছন্ন রাখতে সচেষ্ট আছি। নতুন করে এসব কাজে নামব।’

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে হেলমেট ছাড়া পাম্প থেকে তেল দেওয়া হবে না নির্দেশনা দিলে হেলমেট ব্যবহার বেড়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2019/01/14/725664