১৪ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৮:১০

পোশাক শিল্পে অস্থিরতা

শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা : উল্লেখ নেই গুলিতে শ্রমিক নিহতের ঘটনা

দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের চাকা ঘোরে এবং রিজার্ভের পারদ উপরে উঠে পোশাক রফতানি করে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই সেক্টরে কাজও করেন। সেই পোশাক শিল্পের প্রধান সেক্টর গার্মেন্টসে চলছে অস্থিরতা। মজুরি বৈষম্যের অভিযোগে মূলত এই অস্থিরতা। গত সাত দিন ধরে চলা এই অস্থির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হার্ড লাইনে বিজিএমইএ। নেপথ্যে থেকে কারো ইন্দন রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এরই মধ্যে গতকাল পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে তাদের মজুরি গ্রেডে সমন্বয় করেছে সরকার। গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। তবে নতুন করে মজুরি গ্রেড সমন্বয়ের পর শ্রমিকদের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি কাগজে-কলমে নয়, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন দৃশ্যমান। কর্মস্থলের নোটিশ বোর্ডে বেতনের চার্ট টাঙিয়ে দেয়া হোক। গত ৬ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর মিরপুর ও উত্তরার পাশাপাশি সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা টানা এ বিক্ষোভ করছে। আশুলিয়ায় টানা সপ্তম দিনের মতো গতকালও বিক্ষোভ করেছে পোশাক শ্রমিকরা। বিভিন্ন কারখানার পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করলেও কাজ না করে কার্ড পাঞ্চ করে বের হয়ে যায়। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বাইপাইল আবদুল্লাহপুর মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও জলকামান ব্যবহার করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

চলমান এ বিক্ষোভের সময় দেড় শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেন মালিকপক্ষ। পোশাক শ্রমিকরা যদি আজ সোমবার থেকে কাজে না ফিরে তা হলে মজুরি তো পাবেই না, বরং ওইসব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বিজিএমইএ।

গত ২৫ নভেম্বর পোশাক শিল্পের জন্য নতুন মজুরি কাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করে শ্রম মন্ত্রণালয়। গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নতুন মজুরি কাঠামোতে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক। বিজিএমইএ ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের চেষ্টায় নির্বাচনের আগে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়। তবে গত ৬ জানুয়ারি রোববার ঢাকার উত্তরার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামে। পরের দিনগুলোতে তা রাজধানীর মিরপুর, শেওড়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গত ৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার সংঘর্ষের সময় নিহত হয় সাভারের উলাইলের আনলিমা টেক্সটাইলের শ্রমিক সুমন মিয়া। শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে আশুলিয়া ও সাভার এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

গত শনিবার রাজধানীর মিরপুরে এক অনুষ্ঠানে পোশাক শ্রমিকদের এ বিক্ষোভের ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবে ইন্ধন দিয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা (ডিবি) সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছি, এটা খতিয়ে দেখার জন্য।
কাজে না ফিরলে গার্মেন্টস বন্ধের হুঁশিয়ারি

পোশাক শ্রমিকরা যদি আজ সোমবার থেকে কাজে না ফিরে তা হলে মজুরি তো পাবেই না, বরং ওই সব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বিজিএমইএ। কাওরান বাজারে রোববার দুপুরে বিজিএমইএ ভবনে পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ হুঁশিয়ারি দেন সংগঠনটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদীসহ বিজিএমইএর নেতারা।

বিজিএমইএ সভাপতি শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কর্মস্থলে ফিরে যান, উৎপাদন কাজে অংশ নিন। আর যদি সোমবার থেকে কাজ না করেন, তা হলে আপনাদের কোনো মজুরি দেয়া হবে না এবং ওই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা মোতাবেক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হবে।
আশুলিয়ায় গরম পানির কামান, টিয়ার শেল নিক্ষেপ

স্টাফ রিপোর্টার, সাভার জানান, সপ্তম দিনের মতো শ্রমিক অসন্তোষ অব্যাহত রয়েছে। বন্ধ রয়েছে অন্তত ৩০টির মতো পোশাক কারখানা। আশুলিয়ায় থেমে থেমে সড়ক অবরোধের চেষ্টাকালে শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছে অন্তত ৪০ জন। রোববার সকাল থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশুলিয়ার ইউনিক, জামগড়া, বেরন ও নরসিংহপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত শিল্প কারখানাসমূহের শ্রমিকরা কর্মবিরতি দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও জলকামান ব্যবহার করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এদিকে আতঙ্কিত হয়ে ভাঙচুর এড়াতে আশুলিয়ায় প্রায় ৩০টির মতো পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে। শিল্প পুলিশ-১-এর পরিচালক শানা শামীনুর রহমান জানান, এর আগেও এই এলাকায় একাধিকবার শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছে। যা বেশির ভাগই গুজবের কারণে। শ্রমিকদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন করার চেষ্টা করে এক শ্রেণীর লোক।

তিনি আরো বলেন, শ্রমিক আন্দোলনে আমরা এখনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করিনি। ক্ষেত্রবিশেষে জলকামান ও টিয়ার শেল ব্যবহার করেছি। এ ছাড়া নতুন গ্যাজেট অনুযায়ী কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ না মানলে তা শিল্পপুলিশ অথবা কলকারখানা অধিদপ্তরকে জানানোরও আহ্বান জানান।

জামগড়া এলাকার দি রোজ গার্মেন্টসের মহাব্যবস্থাপক সাধন কুমার দে বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের কারণে আমাদের উৎপাদনে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। কারণ এটা উৎপাদনমুখী শিল্প। উৎপাদন ঠিকমতো হলে এ শিল্প লাভজনক প্রতিষ্ঠানে দাঁড়ায়। আর উৎপাদন না হলে এ শিল্প অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে চলে যায়।

শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা
পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে সাভার থানায় দেড় হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে শিল্প পুলিশ। মঙ্গলবারের শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় এ মামলা হলেও এতে গুলিতে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় পৃথক কোনো মামলাও হয়নি।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, নতুন ঘোষিত বেতন কাঠামো নিয়ে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষের অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে সাভারের গেন্ডা এলাকায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের একটি কারখানার সামনে দেড় হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ করছিল। খবর পেয়ে শিল্পপুলিশের একটি দল সেখানে গেলে শ্রমিকেরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। উত্তেজিত শ্রমিকেরা পুলিশের কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। শ্রমিকদের ছোড়া ইটের আঘাতে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। পরে কাঁদানে গ্যাস ও শর্টগানের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মঙ্গলবার রাতে মামলাটি দায়ের করেন শিল্প পুলিশ-১-এর পরিদর্শক ওসমান গণি। মামলায় তিনি গুলিতে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাটির উল্লেখ করেননি।

সাভার মডেল থানার ওসি আবদুল আউয়াল জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

৬ গ্রেডে মজুরি সমন্বয়
পোশাক শ্রমিকদের দাবির মুখে তাদের মজুরি গ্রেডে সমন্বয় করেছে সরকার। গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। বৈঠকে অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। প্রথম গ্রেডের একজন পোশাক কর্মী সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা বেতন পাবেন। ২০১৮ সালে নতুন মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ১৭ হাজার ৫১০ টাকা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪১৬ টাকা। ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ১৪ হাজার ৬৩০ টাকা ছিল। তৃতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছে ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা, যা ২০১৮ সালের গেজেটে ৯ হাজার ৫৯০ টাকা করা হয়েছিল। চতুর্থ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা। ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ৯ হাজার ২৪৫ টাকা করা হয়েছিল। পঞ্চম গ্রেডে সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছে আট হাজার ৮৭৫ টাকা, যা ২০১৮ সালে আট হাজার ৮৪৫ টাকা করা হয়েছিল। ষষ্ঠ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে আট হাজার ৪২০ টাকা। ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা করা হয়েছিল আট হাজার ৪০৫ টাকা করা হয়েছিল।
আর সপ্তম গ্রেডের মজুরি সব মিলিয়ে গেজেটের মতোই আট হাজার টাকা রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালের কাঠামোতে সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন ছিল পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। সমন্বয় করা মজুরি কাঠামোতে সপ্তম গ্রেডে কোনো বেতন বাড়েনি। তবে প্রথম থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন বাড়ানো হয়েছে।

২০১৮ সালে সপ্তম গ্রেডে বেতন ছিল আট হাজার টাকা। নতুন সমন্বয়ে এই বেতন আগেরটাই রাখা হয়েছে। এর আগে বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দীন বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের নামে যারা ভাঙচুর করেছে তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।

অপর দিকে, শ্রমিক নেতা আমিনুল হক আমিন বলেন, আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে বহিরাগত যারা হামলা-ভাঙচুর করেছে, আমরা চাই তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। তবে নিরীহ কোনো শ্রমিক যাতে হয়রানির শিকার না হয়; সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বৈঠকে সংসদ সদস্য সালাম মুর্শিদী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আফরোজা খান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিজুল ইসলাম, বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সাবেক বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, হামিম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ, জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু, জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামছুন্নাহার ভূঁইয়া, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন এবং শ্রমিক নেতা অ্যাড. মন্টু ঘোষ, সিরাজুল ইসলাম রনি, বাবুল আক্তার, নাজমাসহ মালিক-শ্রমিক নেতারা বৈঠকে অংশ নেন।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্টেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে শ্রমিক নেতারা বলেন, কাগজ-কলমে বেতন বাড়ালে চলবে না। তা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/179112