১৪ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৭:৫৮

ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা

সীমান্তে সতর্কতা; নো ম্যানস ল্যান্ডে কংক্রিটের স্থাপনা বানাচ্ছে মিয়ানমার

রাখাইনে উগ্র বৌদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সাথে চলমান সংঘর্ষের জেরে বিদ্রোহী দমনের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ফের অভিযান চালাচ্ছে। এতে আবারো নাফ নদী পেরিয়ে ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সতর্ক প্রহরা জোরদার করেছে। গত শনিবার রাতে টেকনাফ ২ বিজিবি সতর্কতা জারি করে বলে অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুজ্জামান চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আবারো অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এমন আশঙ্কায় সীমান্তজুড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। এ দিকে কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তের কাছে নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তাড়াতে মিয়ানমার সরকার কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করছে বলে জানিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের এ ঘটনায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে।

গত ডিসেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সাথে সেনাবাহিনীর হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনায় অনেক রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের বুচিদং চিন্দিফ্রাং থেকে পালিয়ে এসেছে ৭ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবার। তারা উখিয়ার কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) রশিদ আহমদ জানান, বুচিদং এলাকায় তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্রোহী আরাকান আর্মি দমনের নামে সরকার ফের বিজিপি সদস্যদের মাঠে নামিয়েছে। রোহিঙ্গারা এ দেশে চলে আসার পর বুচিদংয়ের ক্যাথিও নামে একটি গ্রামে সরকার মুরুং জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করেছিল। বৃহস্পতিবার সেনারা সে গ্রামে অভিযান চালিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ কারণে সেখানে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে গৃহবন্দী অবস্থায় রয়েছে।

এ ছাড়া গত এক সপ্তাহে ভারত থেকে কুমিল্লা হয়ে দ্ইু দফায় ৯৩ জন রোহিঙ্গা কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছে বলে ক্যাম্প ইনচার্জ জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, একটি স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আবারো অধিষ্ঠিত হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে বাধ্য করা হতে পারে। এমন আশঙ্কা করে দেশটির সরকার সে দেশে বিদ্রোহী দমনের নামে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল আহসান খানের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি সে দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সে দেশে কী হচ্ছে সে ব্যাপারে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ব্যাপক নিপীড়ন শুরু করলে তাদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাড়ে ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা। তারা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে বসবাস করছে।

নো ম্যানস ল্যান্ডে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ : আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করছে মিয়ানমার। নো ম্যানস ল্যান্ডের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ উদ্ধৃত করে এই খবর দিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। এজেন্সিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আশ্রয় শিবিরে থাকা স্থানীয় রোহিঙ্গা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের উদ্বেগকে উপেক্ষা করে ওই নির্মাণকাজ চলছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ঘটিয়ে সেখানে স্থাপনা নির্মিত হলে ওই এলাকার তমব্রু খালের পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হবে। ফলে অস্থায়ী শিবিরে আশ্রিত শরণার্থীদের বন্যার কবলে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিককে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়েছে, ঘটনায় উদ্বিগ্ন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছে। বিজিবি কর্তৃপক্ষও আনাদোলুকে বলেছে, সংবাদমাধ্যমে পাওয়া খবরটির সত্যতা যাচাই করছে তারা।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। পরে বাংলাদেশ সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিলেও অনেকেই সেখানের অস্থায়ী বাড়িঘরে থেকে যায়। মিয়ানমারের চলমান স্থাপনা তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

নো ম্যানস ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের তাড়াতে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার বাহিনীকে তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে। আনাদোলু জানিয়েছে, কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি হলে ওই এলাকা রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য অনুপোযোগী হয়ে পড়বে। সেখানকার রোহিঙ্গা নেতাদের অভিযোগ, তাদেরকে উচ্ছেদে বাধ্য করতেই এ পদক্ষেপ নিয়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ আনাদোলুকে বলেন, ওই এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর জন্য নতুন এ কৌশল নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার, নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়া এবং জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার আশা নিয়ে আমরা এখানে আছি। তার দাবি, শুরু থেকেই নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে তাদের তাড়াতে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে মিয়ানমার।

বাংলাদেশী দৈনিকটির প্রকাশিত প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে আনাদোলু জানায়, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল আহমেদ ৮ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। ওই চিঠিতে নো ম্যানস ল্যান্ডে নির্মাণকাজ চলা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। ওই সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, মিয়ানমার সরকার নো ম্যানস ল্যান্ডে কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারে না। এটা করা হলে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে এবং আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা প্রচণ্ড দুর্ভোগের মুখে পড়বে।

বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান তুর্কি সংবাদ সংস্থাটিকে জানান, সম্প্রতি ব্যক্তিগতভাবে তিনি ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। সে সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাকে জানায়, ‘সেখানে কংক্রিটের অবকাঠামো নয়, কাঁটা তারের বেড়া স্থাপন করা হচ্ছে। এ ধরনের বেড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী অন্যান্য সীমান্তরেখায়ও স্থাপন করা হয়েছে।’ কর্নেল হাসান আনাদোলুকে বলেন, প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে এলেও কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের বিষয় এখনো তিনি নিশ্চিত নন। এর সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে গবেষণাকর্মে নিয়োজিত রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান আখন্দ। ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার ‘রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি বই। নো ম্যানস ল্যান্ডে মিয়ানমারের স্থাপনা নির্মাণে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি ধরিয়ে দিয়ে তিনি আনাদোলু এজেন্সিকে বলেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হওয়া ছাড়া কোনো দেশই নো ম্যানস ল্যান্ডে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ চালাতে পারে না। দেশের বাইরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনকেও হুমকিতে ফেলার চেষ্টা করছে মিয়ানমার, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক।’

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/380411