১২ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১:২৯

চালের দাম বাড়ার জন্য মিল মালিকদের দুষছেন ব্যবসায়ীরা

বছরের শুরুতে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৩-৫ টাকা বৃদ্ধির পর সপ্তাহের ব্যবধানে সেই বাড়তি দরই স্থির রয়েছে। হঠাৎ করে দাম বৃদ্ধির পেছনে মিলারদের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের পর মিল পর্যায়ে কোনো বাজার মনিটরিং ছিল না। এ সুযোগে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে। এতে খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছেন।
এদিকে সরকারি হিসাব বলছে, চালের দাম কমেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা কমেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, মোটা চালের দাম কেজিতে এক টাকা করে কমেছে।

চালের দাম বৃদ্ধির তিন কারণ উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রথমত চাল আমদানি প্রায় বন্ধ। দ্বিতীয়ত সরকার আমনের চাল সংগ্রহ শুরু করেছেন। তৃতীয়ত, নির্বাচনের কারণে ধানের জোগান কমে গেছে। ফলে দাম কিছুটা বেড়েছে।

রাজধানীর বেশ কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এবং মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয় দিন আগেও রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হতো ৫০ টাকায়, এখন তা ৫৫ টাকা। ৪০ টাকা কেজির বিআর ২৮ এখন ৪৫ টাকা। একইভাবে স্বর্ণা, নাজিরশাল, পোলাওসহ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এদিকে মিল পর্যায়ে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫১ টাকা কেজি। সে চাল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগে মিনিকেট চাল মিল পর্যায়ে বিক্রি হয় ৪৮ টাকা। আর এ চাল কেজিতে ৪ টাকা বেশি দামে বিক্রি করেন মিল মালিকরা। এক সপ্তাহ আগে একই চাল পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ৪৯ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ে ৪ টাকা। এক সপ্তাহ আগে খুচরা বাজারে মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৪৮-৫০ টাকা। খুচরা বজারে এই চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চালের দাম বাড়া অযৌক্তিক। নির্বাচনের সময় পরিবহন চলাচলে দুয়েকদিন চাল সরবরাহে বাধা পড়তে পারে। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর চালের দাম স্বাভাবিক থাকার কথা। কিন্তু এরপর দাম কমছে না। তাই সরকার সংশ্লিষ্টদের এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।

মাঝারি মানের চাল মিলাররা বিআর-২৮ চাল প্রতি কেজি ৩৫ টাকা বিক্রি করে। এক সপ্তাহ আগে এ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল বিক্রি হয় ৩৭ টাকা। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৩২ টাকা। মিল পর্যায়ে এই চালে দাম বাড়ায় সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে কেজিতে দাম বেড়েছে ৬ টাকা। খুচরা পর্যায়ে একই চাল বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৪ টাকা কেজি। আর এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৩৮-৪০ টাকা।

এছাড়া মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা মিল পর্যায়ে বিক্রি হয় ৩৩ টাকা কেজি। এক সপ্তাহ আগে এ চাল বিক্রি হয় ৩০ টাকা কেজি। পাইকারি বাজারে একই চাল বিক্রি হয় ৩৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগে এ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩২ টাকা। খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৩৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৩৪-৩৬ টাকা। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে এই চালের দাম বাড়ে কেজিতে ২-৪ টাকা।
রাজধানীর বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি নিজাম উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের সময় বিভিন্ন কারণে মোটা ও চিকন চালের দাম ২-৩ টাকা বেড়েছে। এখানে দেশে বড় বড় মিল ও আড়তদাররা আছেন। তারা যদি সিদ্ধান্ত নেন, চালের দাম আর বাড়াব না, তাহলে আর বাড়বে না। তারা যদি বলেন, ১-২ টাকা চালের দাম কমবে, তাহলে কাল থেকেই কমে যাবে। কারণ, সারা দেশে তারাই চাল জোগান দেন।

কাওরান বাজারের বরিশাল রাইস এজেন্সির মালিক হান্নান বলেন, ধানের দাম বেশি, এই অজুহাতে মিল মালিকরা হঠাৎ চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে ম্যাসেজ আসে বস্তায় ৫০ টাকা বাড়বে। এর পর আবার ম্যাসেজ আসে ১০০ টাকা বাড়বে। এই ভাবে বাড়তে গত কয়েক দিনে বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়েছে। তবে দেশে যে পরিমাণে চাল আছে তাতে চালের দাম বাড়ার কথা না। তিনি বলেন, আজ ম্যাসেজ এসেছে চালের দাম কমতে পারে। তবে যতটুকু কমবে তা সন্তোষজনক হবে না। ৩০০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা কমবে, যা কারসাজিরই অন্তর্ভুক্ত বলে তিনি মনে করেন।

আরেক খুচরা চাল বিক্রেতা খালেক বলেন, নির্বাচনের আগে পরে যদি নিয়মিত বাজার ও মিল পর্যায়ে মনিটরিং করা হতো তাহলে দাম বাড়তো না। কিন্তু মনিটরিং না করায় মিল মালিকরা সুযোগ বুঝে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

একই বাজারের খুচরা পর্যায়ে থেকে চাল কিনতে আসা আলী বলেন, কিছুদিন আগে চালের দাম হাতের নাগালে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই চালের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। যে কারণে আমাদের মতো দিনমজুরদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেয়া। তা না হলে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হবে।

মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। বেশি দামে ধান কিনে মিলে আনুষঙ্গিক খরচ ধরেই চালের দাম নির্ধারণ করতে হয়। এতে বর্তমানে চালের দাম কিছুটা বাড়তি রেখে বিক্রি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ অটোমেইল অ্যান্ড হাস্কিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, ধানের দামও বাড়েনি, চালের দামও বাড়েনি। ভোটের সময় একটু গ্যাপ ছিল। সবাই ভোটের মাঠে ছিল। সেই সময় হয়ত ধানের আমদানি কমেছে, চাল উৎপাদন কমেছে। এটা এক দিনের বা দু’দিনের হতে পারে।

সম্প্রতি খাদ্য অধিদপ্তরে চাল ব্যবসায়ী সমিতি, আড়তদার ও অটো মিল মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় চালের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের সহায়তা চেয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, দেশে বোরো ও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। বর্তমানে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই। এর পরও কেন চালের দাম বাড়ছে, আমরা তা জানি না। খাদ্যমূল্য স্থিতিশীলতায় আপনারা আমাদের সহযোগিতা করবেন। এ সময় বিভিন্ন জেলার চাল ব্যবসায়ীরা বাজার স্থিতিশীল রাখতে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন মন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমি পরিষ্কার বলতে চাই, যে দেশে খাদ্য মজুদ থাকে, সে দেশে হুটহাট খাদ্যের দাম বাড়তে পারে না। এটা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। যেকোনো মূল্যে চালের দাম স্বাভাবিক রাখতে কাজ করতে হবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=154169