গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার
১৩ জানুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১:১৫

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বেশি ঝুঁকিতে পাঁচ খাত

পোশাক খাতে চাকরি হারাবে ৬০% শ্রমিক

আগামী ১২ বছরে বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি লোক তাদের চাকরি হারাবে। ম্যাকিন্সি গ্লোবাল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, রোবটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দখল করে নেবে বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্র। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই ঢেউ এসে লাগবে বাংলাদেশেও। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ পাঁচটি খাতে। এ ছাড়া পর্যটন, আসবাবপত্র, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও চামড়াশিল্পেও ডিজিটাইজেশনের কারণে প্রচুর অদক্ষ কর্মী চাকরি হারাবে। শুধু পোশাক খাতেই ৬০ শতাংশ কর্মী চাকরি হারাবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন ও দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল শনিবার তথ্য-প্রযুক্তি পরামর্শক ও সফটওয়্যার সলিউশন কম্পানি ইজেনারেশন আয়োজিত ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব-আমরা কি প্রস্তুত?’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। মহাখালীর ব্র্যাক ইন অডিটরিয়ামে গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডিসিসিআই সভাপতি ওসামা তাসীর, এটুআইয়ের (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন) প্রকল্প পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান এবং এশিয়ান-ওশেনিয়ান কম্পিউটিং ইন্ডাস্ট্রি অর্গানাইজেশনের (অ্যাসোসিও) সদ্যোবিদায়ী সভাপতি আবদুল্লাহ এইচ কাফি।

ইজেনারেশনের পরিচালক (ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন) মুশফিক আহমেদ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এরপর প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুজ্জামান মুক্তা, বিডাব্লিউআইটির সভাপতি লাফিফা জামাল, বুয়েট আইইইইর চেয়ারম্যান প্রফেসর সেলিয়া শাহনাজসহ দেশের বিভিন্ন খাতের কর্তাব্যক্তিরা। এই গোলটেবিল সেশনের সভাপতিত্ব করেন ইজেনারেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান শামীম আহসান।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে সম্প্রতি পাঁচটি খাতের ওপর জরিপের ফলাফল তুলে ধরে এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক শিল্পে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ মানুষ চাকরি হারাবে। এর মধ্যে পর্যটন খাতে ২০ শতাংশ কর্মী ছয় লাখ, চামড়া শিল্পে ৩৫ শতাংশ কর্মী এক লাখ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ছয় লাখ, আসবাবপত্র শিল্পে ১৪ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে।

তিনি বলেন, আটলান্টায় চীনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে একটি কারখানা এসেছে, যারা প্রতিদিন এডিডাস স্পোর্টসের আট লাখ টি-শার্ট উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে যারা এ কাজটি করত তারা এই কাজটি হারিয়েছে। রোবট যখন রোবট তৈরি করবে তখন প্রকৌশলীরা, চালকবিহীন গাড়ি এলে ড্রাইভাররা চাকরি হারাবেন। এই ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হলে এমন শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষতা দিতে হবে, যা কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়ক হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা লাগবে সে বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় নেই। আমাদেরকে ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার দক্ষতার ফারাক কমাতে কাজ করতে হবে।

শামীম আহসান বলেন, স্থানীয় তথ্য-প্রযুক্তি কম্পানিগুলো সর্বশেষ প্রযুক্তি যেমন ব্লকচেইন, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি সলিউশন তৈরি করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একেবারেই প্রাথমিক পর্যায় রয়েছে। আইডিয়া থেকে উৎপাদনের জন্য ‘নেক্সট প্রডাকশন হাব’ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদেরকে চীনের সেনজেনের মতো বর্ধনশীল ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে। বিশ্বে যেভাবে কাজের ধরন পাল্টে যাচ্ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে, আমাদেরকে স্থিতিশীল নেতৃত্ব, বদলিযোগ্য দক্ষতা, উদ্ভাবনী মনোভব এবং মানুষের উপযোগীকরণের পেছনে বিনিয়োগ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আমাদের গৃহীত নানা পদক্ষেপ যেমন একটি বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠাসহ ডিজিটাল রূপান্তরে সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপ বিশ্বের নানা দেশ অনুকরণ করছে। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। আমরা এই বিপ্লবের জন্য আবশ্যক তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষা ও জনবল তৈরিতে প্রধান গুরুত্ব দিয়েছি। এ ছাড়া ডিজিটাল সিকিউরিটি নিশ্চিত করাও অগ্রাধিকার হিসেবে আছে।’

ডিসিসিআই সভাপতি ওসামা তাসীর বলেন, ‘আমরা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব টেকসই উন্নয়নকে গতিশীল করবে। স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, অ্যানালাইটিকস এবং আইওটি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্পায়নে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

আবদুল্লাহ এইচ কাফি বলেন, ‘তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তিন-চার বছরের মধ্যে আমাদেরকে সাইবার সিকিউরিটির জন্য নীতিমালা ও অবকাঠামোগত ফ্রেমওয়ার্ক নিশ্চিত করতে হবে।’

মুশফিক আহমেদ বলেন, ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বা পরবর্তী শিল্প বিপ্লব আলোচিত শব্দের চেয়েও অনেক কিছু। বিশ্বে কানেক্টেড ম্যানুফ্যাকচারিং অথবা স্মার্ট ফ্যাক্টরির আইডিয়া দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বাংলাদেশেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ভালোভাবে শুরু হয়েছে। ভোক্তা এবং ব্যবসাগুলো এআই, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), ব্লকচেইন, ডাটা অ্যানালাইটিকস ইত্যাদি সম্পর্কিত প্রযুক্তি গ্রহণ করছে। উন্নত অর্থনীতির বাংলাদেশের দিকে অগ্রযাত্রায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উন্নয়নের ধাপগুলোকে দ্রুতগতিতে টপকে যাওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/industry-business/2019/01/13/725229