১৩ জানুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১:০৯

ঢাকা-সাভারে শ্রমিক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

সরকার নির্ধারিত নতুন বেতন কাঠামো সমন্বয় ও বাস্তবায়নের দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। গতকাল ঢাকার মিরপুরের দারুস সালাম, টেকনিক্যাল মোড়, বাঙলা কলেজ, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১৪, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। এসময় বিক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ এবং যানবাহন ভাঙচুর করেন। শ্রমিকদের অবস্থানের কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আশেপাশের এলাকাগুলোতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সরাতে পুলিশ বাধা দিলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ১৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। পরে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান থেকে গরম পানি ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে।

এক পর্যায়ে পুলিশ, গার্মেন্টস মালিকদের আশ্বাস ও মিরপুর এলাকায় ছাত্রলীগের অবস্থানের কারণে শ্রমিকরা বিক্ষোভ ছেড়ে কাজে যোগ দেন।

গতকাল সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়ে অবস্থান নেয় অ্যাপারেল এক্সপোর্ট লিমিটেডের পোশাক শ্রমিকরা। বেতন-ভাতার সমন্বয় ও সহকর্মীকে মারধরের প্রতিবাদে প্রায় ১ হাজার ২০০ শ্রমিক বিক্ষোভে নামে। এসময় তাদের সঙ্গে আশেপাশের আরো কয়েকটি কারখানার শ্রমিক যোগ দেয়। এসময় তারা গাবতলী সড়কের টেকনিক্যাল মোড়ে অবস্থান নেয়। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরপুর টোলারবাগ সড়ক, বাঙলা কলেজের সামনে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ছড়িয়ে পড়েন। শ্রমিক বিক্ষোভের কয়েক ঘণ্টা পরও এসব গার্মেন্টসের মালিক পক্ষ বা পুলিশের কোনো তৎপরতা ছিল না। শ্রমিকরা তখন সেখানে দুটি যানবাহন ভাঙচুর করেছে। ফলে এসব সড়ক দিয়ে অন্যান্য যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সহ-সভাপতি নাছির নঈম মুহিম, সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ্দাম, সহ-সম্পাদক লাবু, ছাত্রলীগ কর্মী মানিক চৌধুরীসহ অন্তত ৪০/৫০ জন নেতাকর্মী উপস্থিত হন।

এসময় দু’পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। পরে দুপুর ১টার দিকে শ্রমিকরা প্রধান সড়ক থেকে সরে অ্যাপারেল কারখানার সামনে অবস্থান নেয়। দুপুর ২টার দিকে মালিক পক্ষের আশ্বাসে শ্রমিকরা কাজে ফিরে যায়। অ্যাপারেল কারখানার শ্রমিক রিনা বলেন, প্রতিদিনের মতো সকালে এসে আমরা কাজে যোগ দেই। এসময় বেতন বাড়ানোর কথা বলাতে আমাদের এক সহকর্মীকে মালিক পক্ষের লোকজন মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেয়। এ খবর সবাই জানাজানির পর আমরা কাজ ছেড়ে বিক্ষোভে নামি। আহমেদ ফ্যাশন ইউনিট-২ এর শ্রমিক দীন ইসলাম বলেন, মালিক পক্ষের জসিম নামের এক কর্মকর্তা চন্দন নামে এক শ্রমিককে মারধর করার প্রতিবাদ ও বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে সকালে আমরা টেকনিক্যাল মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। পরে মালিক পক্ষের আশ্বাসে আমরা সেখান থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। মো. মনির নামের আরেক শ্রমিক বলেন, আমাদের বেতন বাড়ানো তো দূরের কথা যা সুযোগ-সুবিধা পেতাম সেটাও এখন কমানো হয়েছে। মিলন নামের এক শ্রমিক বলেন, আলাদা আলাদা বেতনের শিট তৈরি করা হয়। শিটে যে বেতনের কথা উল্লেখ থাকে সে বেতন আমাদের দেয়া হয় না।

মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাদন ফকির বলেন, সরকার নির্ধারিত বেতন বাস্তবায়নের দাবিতে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। রাস্তায় নামার কারণে সড়কে যানবাহন চলাচল করতে পারছিলো না। পুলিশ তাদেরকে পরে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।

আশুলিয়ায় বিক্ষোভ-
সড়ক অবরোধ, আহত ৩০
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, সাভারের আশুলিয়ায় মজুরি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে তা সংশোধন এবং সমহারে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে টানা ষষ্ঠ দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল, জলকামান ব্যবহার ও লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, গতকাল সকাল ৯টায় আশুলিয়ার বেরন এলাকার ইয়াগী বাংলাদেশ লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা প্রথমে মজুরি বৈষ্যমের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করেন। এসময় তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন পার্শ্ববর্তী স্টারলিংক ক্রিয়েশন, উইন্ডি গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের জামগড়া ও বেরন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে। এসময় পুলিশ প্রথমে শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা দাবি আদায়ে অনড় হয়ে রাস্তায় অবস্থান নিলে পুলিশ জলকামান, টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে। পরে দুই ঘণ্টাব্যাপী দফায় দফায় সড়ক অবরোধ করে প্রায় ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা সংঘর্ষে প্রায় ৩০ জন শ্রমিক আহত হন।

এদিকে বেরন এলাকার শারমিন গ্রুপের এএম ডিজাইন কারখানার শ্রমিকরা দুপুরের খাবার খেতে বাসায় যাওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা স্থানীয় বিভিন্ন শাখা সড়কে অবস্থান নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান। কেউ আবার কারখানায় ফিরে এসে কাজে যোগদান করেন। এএম ডিজাইন কারখানার শ্রমিক আলামিন বলেন, বেতন কম হওয়ার পরও আমরা আন্দোলন না করে কাজ করায় দুপুরে খাবার খেতে বাসায় যাওয়ার পথে পার্শ্ববর্তী স্টারলিংক কারখানার আন্দোলনকারী শ্রমিকরা আমাদেরকে মারধর করেন। কারখানাটির মালিক ইসমাইল হোসেন বলেন, আমাদের কারখানায় কোনো সমস্যা নেই। সবাই কাজ করছেন। কিন্তু বহিরাগত শ্রমিকরা তাদেরকে মারধর করে আন্দোলনে অংশ নিতে বাধ্য করছেন। অন্য একটি কারখানার শ্রমিক শারমিন, পারভিন ও নাজমা আক্তার জানান, বেতন বৈষম্যের অভিযোগে সাধারণ শ্রমিকরা আন্দোলন করায় কারখানার স্টাফ ও ভাড়াটে লোকজন আমাদেরকে মারধর করে আটকে রাখেন।

এসময় তারা বেশ কয়েকজন শ্রমিককে মারধর করেন। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জাকির হোসেন নামে এক স্টাফকে মারধর করে কারখানার ভেতরে পুকুরে ফেলে দেন। পরে কারখানার লোকজন তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করেন। নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে জাকির হোসেন, বাবু মিয়াসহ আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিককে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে দিনব্যাপী চলা সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ শ্রমিক আহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন আন্দোলনকারী শ্রমিকরা। শিল্প পুলিশের পরিচালক সানা শামীনুর রহমান বলেন, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধ করে প্রায় ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে জলকামান, টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিই। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শিল্প এলাকায় ৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন।

গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষ
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে জানান, গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় গতকালও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। শ্রমিকরা সড়কে নেমে আসলে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় কয়েক দফা। শ্রমিক আন্দোলনের জেরে অন্তত ২০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

পুলিশ ও আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবির আন্দোলনে শনিবার সকালে গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার টার্গেট ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-গাজীপুর সড়ক অবরোধের চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে, লাঠিপেটা করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।

এছাড়া মোগরখাল এলাকায় বিসিএল কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিলে তাদের সঙ্গে মালিকপক্ষের লোকজনের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। নগরের কোনাবাড়ী বিসিক এলাকায় কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ সৃষ্টি করতে চাইলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া, কোনাবাড়ী, মোগরখাল এলাকাসহ আশেপাশের এলাকার অন্তত ২০টি কারখানা ছুটি দেয়া হয়। গাজীপুরের শিল্প এলাকাগুলোর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=154340&cat=2