১৩ জানুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১:০৭

ক্যাবের ২০১৮ সালের জরিপ

জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ

সদ্যবিদায়ী বছরে (২০১৮ সাল) দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ শতাংশ। এর মধ্যে পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের ক্ষেত্রে বেড়েছে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি মানুষের জীবনমানে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ায়। এর ফলে হতাশা আর অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে- জীবনযাত্রার এ ব্যয় বৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় কম হারে বেড়েছে।

২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের ক্ষেত্রে বেড়েছিল ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পণ্য ও সেবামূল্যের বৃদ্ধি চলতি বছর সহনীয় রাখতে সরকারের কাছে ১০ দফা সুপারিশও এতে তুলে ধরা হয়েছে।

শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান। এ সময় অন্যদের মধ্যে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবার তথ্য বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বিদায়ী বছরে শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াতের ব্যয়।

এ সময় ক্যাব সভাপতি জানান, ভোক্তার ঝুলিতে যেসব পণ্য ও সেবা রয়েছে সেসব পণ্য বা সেবা পরিবারের মোট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে পণ্য বা সেবার ওজনের ভিত্তিতে জীবনযাত্রা ব্যয়ের এ হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল এবং বাস ও রেলের ভাড়া বাড়েনি। পণ্যের মূল্য বহুলাংশে স্থিতিশীল ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল এবং গুঁড়ো দুধ। এ ছাড়া বছরজুড়ে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ছিল এবং বছরের শেষে চালসহ বেশকিছু পণ্যের মূল্য ছিল নিুমুখী।

যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে : ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সাবানের মূল্য যা গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে মাছের দাম বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, শাকসবজিতে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, চাপাতায় ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, পান-সুপারিতে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ, তরল দুধে ১০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, গরম মসলায় ৮ শতাংশ, মাংসে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, মুরগিতে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, ডিমে ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। ২০১৮ সালে দেশি থান কাপড়ের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ আর বিদেশি কাপড়ের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, দেশি শাড়ির দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ আর গেঞ্জি, তোয়ালে ও গামছায় দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। নারিকেল তেলের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মূল্য প্রতি হাজার লিটারে বেড়েছে ৫ শতাংশ। দুই-কক্ষবিশিষ্ট বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

দাম কমেছে : আগের বছরের তুলনায় ডাল, লবণ, মসলা, চিনি ইত্যাদি পণ্যের দাম কমেছে। দেশি মসুর ডালের দাম কমেছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, আমদানিকৃত মসুর ডালে কমেছে ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, আস্ত ছোলায় দাম কমেছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশে উৎপাদিত রসুনের দাম কমেছে কেজিপ্রতি ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ আর আমদানিকৃত রসুনের দাম কমেছে ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, কাঁচা মরিচের দাম কমেছে ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। চিনির দাম কমেছে ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ, লবণের দাম কমেছে গড়ে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ। বেশকিছু শাকসবজির দামও নিুমুখী ছিল। যেমন: লালশাকের দাম কমেছে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, পটোলের দাম কমেছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ, ঝিঙ্গার দাম কমেছে ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, আর ঢেঁঢ়সের দাম কমেছে ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

পর্যবেক্ষণে যা দাবি করা হয় : ক্যাব পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছে, ২০১৮ সালে গণপরিবহনে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান ছিল আগের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ ও ব্যয়বহুল। আরও দাবি করা হয়, ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও এক শ্রেণীর ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধে অনীহা এবং ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এতে আমানতের সুদ কমছে, ঋণের সুদ বাড়ছে আর নিত্যনতুন সার্ভিস চার্জ আরোপ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণকারী ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বিদ্যুৎ প্রসঙ্গে বলা হয়, ক্যাব মনে করছে, বিতরণ কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের কাছে চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। কম খরচে বিদ্যুতের উৎপাদনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। স্বল্পব্যয়ে উৎপাদন কৌশল গ্রহণ না করায় ভোক্তার বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। দেশে গ্যাসের মজুদ প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। এতে দেশের শিল্পায়ন ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানির কোনো বিকল্প নেই। তবে আমদানিকৃত এলএনজির মূল্য দেশীয় কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাসের মূল্যের কয়েক গুণ বেশি। গ্যাসের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে আমদানিকৃত এলএনজি সকল প্রকার শুল্ক-করমুক্ত এবং আমদানি ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিসমূহে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ এবং বিইআরসির মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মূল্য নির্ধারণ যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য হবে। আর বিইআরসির মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কস্ট-প্লাস ভিত্তিতে প্রতিটি কোম্পানির এলপিজি সিলেন্ডারের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ সময়োপযোগী হবে। ‘উবার’ ও ‘পাঠাও’র কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকদের দৌরাত্ম্য কিছুটা হলেও কমেছে। পরিবহন ব্যয় প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের সম্প্রসারণ সত্ত্বেও যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যয় কমেনি। সরকারিভাবে বাস ভাড়া বৃদ্ধি করা না হলেও বাসচালকদের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

পণ্য ও সেবার দাম সহনীয় রাখতে ১০ সুপারিশ : উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে ক্যাব দাবি করেছে, এর জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিকল্প নেই। এ পেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য ১২ থেকে ১৫টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করা আবশ্যক। পাশাপাশি এসব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার কার্যকর উদ্যোগও সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। ১. এর জন্য ‘ভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করা যেতে পারে। ২. ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করা ও তাদের জন্য শস্য বীমার প্রথা প্রবর্তন করা; ৩. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংস্কার সাধন করা এবং ‘প্রাইস স্টেবিলাইজেশন ফান্ড’ সৃষ্টি করে জ্বালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা এবং এলএনজি আমদানি সকল প্রকার শুল্ক-করমুক্ত রেখে গ্যাসের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা। ৪. যাত্রী দুর্ভোগ ও যানজট কমানোর লক্ষ্যে ঢাকায় বাস চলাচলের ক্ষেত্রে ফ্র্র্যাঞ্চাইজি প্রথা প্রবর্তন, র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ যোগাযোগ খাতের প্রকল্পসমূহের দ্রুত ও সময়মতো বাস্তবায়ন করা। ৫. ডাক্তারদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ; বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা প্রদান নিশ্চিত করা। ৬. অবিলম্বে শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ৭. সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে পর্ষদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং আইনের সংস্কার করে দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা; ৮. আমদানি শুল্কের ব্যাপক হ্রাস এবং লবণসহ যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ অবিলম্বে সেসব পণ্যের অবাধ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা, ৯. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণে সব ধরনের আইন বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ১০. অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল যাতে সুষম বণ্টন হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা; আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/news/132601