১৩ জানুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ১:০৪

মিলারদের কারসাজিতে বাড়তি চালের দাম

দুই সপ্তাহ ধরে সব ধরনের চাল কেজিতে ৪-৬ টাকা বাড়তি * বাণিজ্য ও খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকের পরও কমেনি দাম

বছরের শুরুতেই মিলারদের কারসাজির বেড়াজালে পড়েছে চালের দাম। দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত চাল মজুদ আছে। সঙ্গে আমন ও বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে।

এরপরও অতি মুনাফার লোভে মিলাররা কারসাজি করে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছে ৪-৬ টাকা। যা দুই সপ্তাহ পরও বাড়তিই আছে। এদিকে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে বৃহস্পতিবার মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য ও খাদ্যমন্ত্রী। এরপর দুই দিন অতিবাহিত হলেও চালের দাম কমেনি। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে নিু আয়ের মানুষ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই দিন আগেই মিলাররা বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে পরিবহন সংকটের কারণে চালের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। আর নির্বাচনের পর ধানের দাম বেশি এই অজুহাতে চালের দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন মিল মালিকরা। তবে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য ও খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিল মালিকদের বৈঠকে তারা বলেছেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়েনি।

মিলারদের দুই ধরনের কথায় গোলকধাঁধা সৃষ্টি হয়েছে। তবে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছে।

নির্বাচনের তিন দিন আগেই মিলাররা বাজারে চালের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। সে সময় মিলাররা পরিবহন বন্ধের অজুহাত দেখায়। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার পরও এখন পর্যন্ত চালকল মালিকরা বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ায়নি। যে কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম কমছে না। তারা বলছেন, মিলাররা ভেবেছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়ায় সরকারি দলের সঙ্গে এক ধরনের কোন্দল হবে।

এতে দেশের পরিবহন সেক্টর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। আর এই সুযোগে তারা কারসাজি করে চালের দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফা লুটবে। কিন্তু এ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলেও মিলাররা নানা অজুহাতে অতি মুনাফা করছে। এ কারণে ভোক্তারা বেশি দামে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।

চালের দাম বাড়ার বিষয়ে মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পর্যাপ্ত মজুদও আছে। কোনো ধরনের অসাধু উদ্দেশ্য ছাড়া চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তবে চালের দাম কিভাবে কমিয়ে আনা যায় এ জন্য কাজ করা হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে শনিবার জানা গেছে, ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৫৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১১ লাখ ৭৯ হাজার টন ও গম ১ লাখ ৭৫ হাজার টন। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ সন্তোষজনক। মাসিক চাহিদা ও বিতরণ পরিকল্পনার তুলনায় পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই বা ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, সদ্য শেষ হওয়া আমন মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এ মৌসুমে ৫৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫৯৪ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আর আউশ ও বোরোর ফলনও ভালো হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা মণে ধান বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাজারে ধান ও চালের প্রচুর সরবরাহ রয়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

এদিকে শনিবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজার এবং দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিল পর্যায়ে মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫১ টাকা কেজি। সেই চাল পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকা কেজি।
দুই সপ্তাহ আগে মিনিকেট চাল মিল পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা কেজি। আর শনিবার পর্যন্ত এ চাল কেজিতে ৪ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়। দুই সপ্তাহ আগে একই চাল পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ৪৯ টাকায়। পাইকারি পর্যায়ে এই চালের দাম এখনও ৪ টাকা বাড়তি। এ ছাড়া দুই সপ্তাহ আগে খুচরা বাজারে মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৪৮-৫০ টাকা কেজি। আর শনিবার খুচরা বাজারে এই চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়েছে।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ করে চালের দাম বাড়া অযৌক্তিক। কারণ দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ ও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে নির্বাচনের সময় পরিবহন চলাচলে বাধা ছিল। সে সময় দু-একদিন চাল সরবরাহে বাধা পড়তে পারে। এ জন্য দাম বাড়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর চালের দাম স্বাভাবিক থাকার কথা। কিন্তু এরপরও যেহেতু দাম কমছে না, তাই সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। দাম যেন আর না বাড়ে সেই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ জন্য বিশেষভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে।

মিলাররা শনিবার বিআর-২৮ চাল প্রতি কেজি ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছে। দুই সপ্তাহ আগে এ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩০ টাকায়। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৭ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে যা বিক্রি হয় ৩২ টাকায়। মিল পর্যায়ে এ চালের দাম বাড়ায় পাইকারিতে কেজিতে দাম বেড়েছে ৬ টাকা। যা এখন পর্যন্ত কমেনি। শনিবার খুচরা পর্যায়ে একই চাল বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৪ টাকা কেজি। আর দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৩৮-৪০ টাকায়।

এ ছাড়া মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা মিল পর্যায়ে শনিবার বিক্রি হয়েছে ৩৩ টাকা কেজি। দুই সপ্তাহ আগে এ চাল বিক্রি হয় ৩০ টাকা কেজি। পাইকারি বাজারে একই চাল শনিবার বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে এ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৩২ টাকায়। শনিবার খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়। যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয় ৩৪-৩৬ টাকায়। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এই চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৪ টাকা।

রাজধানীর চালের বৃহৎ পাইকারি আড়ত বাবুবাজার-বাদামতলীর আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী নিজাম উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের সময় বিভিন্ন কারণে মোটা ও চিকন চালের দাম কেজিতে দুই থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। দেশের বড় বড় মিল ও আড়তদাররা আছেন তারা যদি সিদ্ধান্ত নেন চালের দাম আর বাড়বে না। তাহলে আর বাড়ার সুযোগ নেই। তারা যদি বলেন, কেজিতে এক থেকে দুই টাকা কমবে তাহলে কাল থেকেই কমে যাবে। কারণ সারা বাংলাদেশে তারাই চালের জোগান দিয়ে থাকেন।

মালিবাগ বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা খালেক রাইস এজেন্সির মালিক দিদার হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হতো। মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিয়মিত মনিটরিং হতো। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পর বাজার তদারকি হচ্ছে না। যে কারণে মিল মালিকরা সুযোগ বুঝে এক হয়ে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তবে দিনাজপুর জেলা চালকল মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা হুমায়ুন ফারুক চৌধুরী শামীম জানান, বাজারে ধানের দাম অনেক বেশি। এরপরও ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দামে ধান কেনায় চাল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই চালের দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, বাজারে সবচেয়ে বেশি চালের চাহিদা রয়েছে বিআর-২৮ ও মিনিকেট জাতের। আর এ জাতের ধানের উৎপাদন হয় এপ্রিলে। এ সময়টাতে এই জাতের ধান না পাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ করে চালের দাম বেড়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চাল ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্টদের বৈঠক হয়। এর পর মন্ত্রীর নির্দেশে আজ (রোববার) সারা দেশের মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিশেষভাবে মনিটরিং করা হবে। দাম বাড়ানোর পেছনে যাদের পাওয়া যাবে, তাদের ভোক্তা আইনে শাস্তি দেয়া হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/city/132566