১১ জানুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ১১:৪২

শৃঙ্খলা ফেরেনি গণপরিবহনে

সড়ক-মহাসড়কে প্রাণহানি বাড়ছেই

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকারের উচ্চমহল থেকে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। সরব হয়েছিল পরিবহন মালিক সমিতিও। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কয়েক মাসের ব্যবধানে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে গণপরিবহন সেক্টর। সড়ক-মহাসড়কে চলছে ফিটনেসবিহীন লক্কর ঝক্কর বাস, চলছে চালক হেলপারদের দৌরাত্ম। চালকদের সিগনাল না মানা, যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো, পাল্লা দিয়ে ছুটে চলার প্রবনতা এখনও বহাল আছে। একই সাথে পথচারীদের পুরনো অভ্যাসও পরিবর্তন হয়নি। তারাও ফুটওভার ব্রিজ রেখে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দ্বিধা করছেন না।

দেশের সড়ক-মহাসড়ক এবং গণপরিবহনে শৃঙ্খলা বিধান মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলে জানিয়েছেন নতুন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ে একথা জানান। মন্ত্রী বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা বিধান অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে সড়ক প্রশস্তকরণের সুফল জনগণ পাবে না। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আইন প্রয়োগে গাফিলতি ও ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতি রোধ করতে না পারলে কোনোদিনই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। তিনি বলেন, বর্ততান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সড়ক নির্মাণ ও অবকাঠামোখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। সে হিসাবে সড়ক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলায় কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি। নতুন সরকার যদি সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারে তাহলে জাতি এই সরকার তথা সড়ক পরিবহন মন্ত্রীকে বহুদিন মনে রাখবে।

গত এক বছর ৮ মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৯২৩ জন। সড়কে মৃতু্যৃর এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। বরং দিন যতো যাচ্ছে পরিস্থিতির ততোই অবনতি ঘটছে। গেল বছর চট্টগ্রামে বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যা, কুষ্টিয়ায় বাসের ধাক্কায় মায়ের কোলে থাকা শিশুর মৃত্যু, মিরপুরে জব্দ করা বাসচাপায় পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর মতো নৈরাজ্য সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। মাঝখানে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশের সড়কের চিত্র অনেকটাই পাল্টে যায়। কিন্তু সেটা বেশিদিন টিকেনি।

বরং বছরের শেষের দিকে নির্বাচনী ডামাডোলে সব শৃঙ্খলা চাপা পড়ে গেছে। ভুক্তভোগিদের মতে, নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশের ব্যস্ততার কারনে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই ছিল না।

এখনও সে অবস্থা রিরাজমান। রাজধানীসহ সারাদেশের সড়কে-মহাসড়কে বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চলাচল, পাল্লাপাল্লি করে ছুটে চলা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করানো, ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে হাত উচিঁয়ে গাড়ি থামিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার কোনোটাই বন্ধ হয়নি। এর সাথে ভাড়া নিয়ে জালিয়াতি, সিটিং ও বিরতিহীনের নামে প্রতারণাতো আছেই।

রাজধানীর সড়কে এখনও চলছে ফিটনেসবিহীন বাস ও মিনিবাস। ভুক্তভোগি যাত্রীদের অভিযোগ, আগের মতোই কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এখনও চলছে। ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের সড়ক-মহাসড়কে এখনও ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন চলছেই। এ প্রসঙ্গ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা শহরের যে কোনো স্পটে দাঁড়িয়ে দেখলেই বোঝা যায়, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে। অবশ্য গণপরিবহনের মালিকপক্ষের দাবি, নগরীতে এখন যেসব বাস চলাচল করছে সেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে। যেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই, সেগুলো রাস্তায় নামছে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, এখনও ফিটনেসবিহীন বাস বা মিনিবাস চলাচল করছে। আলাপকালে কয়েকজন চালক জানান, পুলিশ আগের মতো আর কাগজপত্র চেক করে না।

এই সুযোগে অনেক বাসই রাস্তায় নেমেছে। গতকাল দুপুরে সরেজমিনে গুলিস্তান এলাকায় কয়েকটি বাস পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাসের সীট নড়বড়ে, দরজা-জানালা নাই, বডি থেকে টিন খুলে পড়েছে, সামনে-পেছনের লাইট জ্বলে না, হুইস পাইপ দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, চলতে গিয়ে বিকট শব্দ হচ্ছে আরও কতো কি? চলাচলের ক্ষেত্রে এসব বাসের বেপরোয়া গতি যাত্রীদেরকে আতঙ্কিত করে তুলছে। চিটাগাং রোড থেকে গুলিস্তানে আসা নাসের নামে এক যাত্রী বলেন, হিমালয় পরিবহনের একটি বাসে তিনি এসেছেন। বাসটির চালক অল্প বয়সি। পথিমধ্যে সে বেশ কয়েকটি বাসকে পেছনে ফেলার জন্য খুবই দ্রুতবেগে এসেছে। এক পর্যায়ে ঝুঁকির কথা ভেবে যাত্রীরা হই চই শুরু করলে চালক কিছুটা শান্ত হয়ে গাড়ি চালায়। তারপরেও পথিমধ্যে সে যাত্রী তোলার জন্য এক ঘণ্টারও বেশি সময় নষ্ট করেছে। হাসান নামে একজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, রায়েরবাগ থেকে যাত্রাবাড়ীর ভাড়া ১০ টাকা হলেও ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে আসার কারণে অনেকের কাছে থেকে ১৫ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়েছে। পথিমধ্যে বাসটি ফ্লাইওভারের উপরেই দুই বার দাঁড়িয়ে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা সময় নষ্ট করেছে।

এদিকে, ট্রাফিক পুলিশের অভিযোগ, রাজধানীতে যাত্রীদের সচেতনতা মোটেও বাড়েনি। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট প্রশ্ন রেখে বলেন, যাত্রীরা সচেতন না হলে পুলিশ একা কি করবে? যাত্রীদের এই অসচেতনতার দৃশ্য চোখে পড়ে বাংলামোটর, কাওরানবাজার, পল্টন, বিজয়নগর এলাকায়। এসব পয়েন্টে বাসগুলো যেমন সিগনালের পরোয়া করে না, তেমনি যাত্রী বা পথচারীরাও ফুটওভার ব্রিজ রেখে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হয়। সব মিলে গণপরিবহনে আগের মতোই বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করছে। যা সাধারণ মানুষকে হতবাক ও হতাশ করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রভাবশালী রাজনীতিকদের বাস কোম্পানি থাকায় এতোদিন ফিটনেসবিহীন, রংচটা, লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসের বিরুদ্ধে খুব একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী মালিকের বাস চালকেরা বরাবরই বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে কোনো যাত্রী উচ্চবাচ্য করলে তাদের শায়েস্তা করার জন্যও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিজেদের লোক রাখেন পরিবহন মালিকেরা। এ কারণে সিটিং, বিরতিহীন, সময় নিয়ন্ত্রণ, গেইটলকসহ নানা কৌশলে সরকার-নির্ধারিত হারের দু-তিন গুণ ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল পান না যাত্রীরা। কিছুদিনের জন্য সে অবস্থার পরিবর্তন হলেও আবার আগের পরিবেশই ফিরে এসেছে।

ট্রাফিক পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এসব পরিবহন সেক্টরের প্রভাবশালী মহল কিছুদিনের জন্য নিস্ক্রিয় থাকলেও কিছুদিন পর তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ কারণে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দিতে বাধ্য হয়। এভাবে ছাড় দিতে দিতে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে পরিবহন সেক্টর।

গণপরিবহনের শৃঙ্খলা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিআরটিএ’র পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) আব্দুস সাত্তার ইনকিলাবকে বলেন, বিআরটিএ-তে ম্যাজিস্ট্রেট আছেন মাত্র ১০জন। তাদেরকে দিয়ে মাসে ২০/২২ দিন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, মাত্র ১০টি মোবাইল কোর্ট দিয়ে পুরো রাজধানী কভার করা সম্ভব নয়, তারপরেও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেখা যায় কোনো এলাকায় মোবাইল কোর্ট বসলে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমাদের কিছুই করার থাকে না।

ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মফিজ উদ্দিন আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের তরফ থেকে যে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে পুলিশ সেগুলো বাস্তবায়নে মাঠে কাজ করবে। কিছু দিনের মধ্যেই বিআরটিসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সড়কে নতুন বাস নামাবে। তখন পর্যায়ক্রমে লক্কর-ঝক্কর বাস তুলে ফেলা হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/178556