১১ জানুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ১১:২২

অর্ধশত পোশাক কারখানায় ছুটি

দাবি আদায়ে এখনও রাজপথে শ্রমিকরা

মিরপুরে সড়ক অবরোধ আশুলিয়ায় আহত ৩০ * পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে মূল সমস্যা চিহ্নিত * ‘শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য’ সমাধান প্রত্যাশা করে জার্মান রাষ্ট্রদূতের টুইট

ন্যূনতম মজুরির দাবি, মজুরি কাঠামো পুনর্নিধারণসহ বিভিন্ন দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা টানা পঞ্চম দিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করছেন।

পুলিশ ও কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে শ্রমিকরা ঘরে ফিরে গেলেও পরদিন তারা আবার রাজপথে নামছেন। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর মিরপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় সড়ক অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করেন।

কয়েকটি স্থানে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের ৩০ জন আহত হয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আশুলিয়ার অর্ধশত কারখানায় ছুটির নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বৃহস্পতিবার পর্যালোচনা কমিটির প্রথম বৈঠকে মজুরি কাঠামোর মূল সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ও ‘শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য’ সমাধান প্রত্যাশা করে টুইট বার্তা দিয়েছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফাহরেনহোল্জ।
আন্দোলনের পঞ্চম দিনে আশুলিয়ার বেরন, কাঠগড়া, কুটুরিয়া, জামগড়াসহ কয়েকটি এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তারা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।

এ সংঘর্ষের কারণে আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কসহ আশপাশের সড়কে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা কোনো যান চলাচল করতে পারেনি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ।
সকাল সাড়ে ৮টায় বেরন এলাকার শারমিন গ্রুপের এএম ডিজাইন কারখানার শ্রমিকরা কারখানার সামনের সড়কে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। পুলিশ বাধা দিলে তাদের লক্ষ্য করে শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় ওই কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে পাশের স্টার্লিং অ্যাপারেলস, উইন্ডি গ্রুপ, সেতারা গ্রুপ, ডিজাইনার জিন্সসহ ১৫টি পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক যোগ দেয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দফায় দফায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সময় ২০ জন আহত হন।

এদিকে আশুলিয়ার কাঠগড়ার বিশমাইল-জিরাব এলাকায় সকাল থেকে শ্রমিকরা সড়কে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে পুলিশ শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

পরে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শ্রমিকরা মূল সড়ক থেকে সরে গলিতে চলে যায়। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে ১০ শ্রমিক আহত হয়। শ্রমিকরা জানান, বেতন বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে তারা কারখানার উৎপাদন বন্ধ রেখে সড়কে নেমেছেন। দাবি না মানায় তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। মজুরি কাঠামো অনুযায়ী তাদের বেতন বৃদ্ধি পায়নি। এছাড়া ওভারটাইম, চিকিৎসা ও বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি। ঢাকা-১ আশুলিয়া শিল্প পুলিশের এসপি সানা সামিনুর রহমান বলেন, শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

ঢাকায় সড়ক অবরোধ : সকাল সাড়ে ৮টায় মিরপুরের কালশী ও শেওড়াপাড়ায় সড়কে বসে পড়েন পোশাক শ্রমিকরা। কালশীতে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসহ আশপাশের কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেন। এতে কালশী রোড ও আশপাশের সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার জন্য স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যসহ জলকামান, সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের মালিক মোশাররফ হোসেন শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সকাল পৌনে ১০টার দিকে শ্রমিকরা ১২ জানুয়ারি শনিবার থেকে কাজে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে। পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইমরানুল হাসান বলেন, নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার আশ্বাসের পর শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করেন।

সকাল ১০টার দিকে মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় আলফা ইউনিট ১ ও ২ লিমিটেডের পোশাক শ্রমিকরা সড়কে বিক্ষোভ শুরু করে। এরপর ওই এলাকার কয়েকটি গামেন্ট থেকে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় সড়কের উভয় পাশে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এক ঘণ্টা পর পুলিশ তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) দুলাল হোসেন বলেন, শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

জার্মান রাষ্ট্রদূতের টুইট বার্তা : পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে এ সংঘাতের একটি ‘শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য’ সমাধান প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফাহরেনহোল্জ। বৃহস্পতিবার এক টুইটে তিনি বলেন, ধর্মঘটকারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের দমন করা উচিত নয়। কারখানা মালিকদের এ নিয়ে সমঝোতা করতে হবে। ন্যায্য বেতন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। দুর্ঘটনা বীমা চালু করারও আহ্বান জানান তিনি। আরেক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘আমি এই সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায্য সমাধানের পক্ষে।’

পর্যালোচনা কমিটির বৈঠক : পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো পর্যালোচনায় গঠিত ১২ সদস্যের কমিটির প্রথম সভা বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে শ্রম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খান। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, মজুরি কাঠামোর ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে মূলত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা শনাক্ত হওয়ায় সমাধানও করা যাবে।

আগামী রোববার কমিটির পরবতী বৈঠকে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে কমিটিকে এক মাসের সময় দেয়া হয়েছে। ওই সময়ের আগেই সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের কারও বেতনই কমবে না।

মজুরি কাঠামোর কারণে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে তা নয়, এর পেছনে অন্য ঘটনা রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মজুরি কাঠামোর চেয়ে বেশি বেতন দেয়া হলেও একটি কারখানা ভাংচুর করা হয়েছে।

কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খান আরও বলেন, অর্থনীতির মূলভিত্তি হল গার্মেন্ট খাত। অথচ এ খাতকে ধ্বংস করার জন্য একটি চক্র পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। এ কারণে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, শুধু বেতনই নয়, শ্রমিকরা যে কোনো সমস্যায় পড়লে সহায়তা পেতে একটি হটলাইন নম্বর চালু করবে শ্রম অধিদফতর। ২৪ ঘণ্টা সেই নম্বরে ফোন দিয়ে শ্রমিকরা তাদের সমস্যা জানাতে পারবেন। সমস্যা যাতে তাৎক্ষণিক সমাধান হয় তার ব্যবস্থাও থাকবে।

নম্বরটি শিল্প অঞ্চলে মাইকিং করে জানানো হবে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম এবং বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শিদী। গার্মেন্ট মালিক, শ্রমিক ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা কমিটির ১২ সদস্যের মধ্যে ১০ জন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/131795