১১ জানুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার, ১০:৫৩

পোষাক শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে আহত ৫০

ন্যূনতম মজুরির দাবিতে পোশাক শ্রমিকেরা গতকাল বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ করেছেন। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই বিক্ষোভ চলছে। সকালে আশুলিয়ার কাঠগড়া, কুটুরিয়া, জামগড়াসহ কয়েকটি এলাকায় রাস্তায় নামেন পোশাক শ্রমিকেরা। পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে দুই পক্ষের ৫০ জনের মতো আহত হয়েছেন। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে আশুলিয়া এলাকায় অর্ধশত কারখানা বন্ধ।

আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশ ও শ্রমিকসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের আশুলিয়ার বেরন এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরে বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের পর টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন জানান, শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় আশুলিয়ার কাঠগড়া ও জামগড়াসহ বেশ কিছু এলাকার ২৫টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

অন্যদিকে সাভারের হেমায়েতপুর, কর্নপাড়া ও সাভার থানাস্ট্যান্ড এলাকাসহ বিভিন্ন গার্মেন্টসের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বিজিবি তাদের গাড়ি নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে টহল দিচ্ছে। শ্রমিক আন্দোলনের মুখে সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক কারখানাগুলোর সামনে বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।

বুধবার শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে প্রায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সাভার। ওই এলাকা গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল শান্ত। গত তিন দিনের মতো গতকাল অবশ্য রাজধানীর কালশী রোডে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসের সামনে অবস্থান নেন শ্রমিকেরা। দুপুর ১২টার দিকে মালিকদের সঙ্গে আলোচনার পর চলে যান শ্রমিকেরা।

সকালে আশুলিয়ার কাঠগড়ায় রাস্তায় নেমে আসেন শ্রমিকেরা। এসব শ্রমিককে সরে যেতে বলে পুলিশ। তাঁরা না সরলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। শ্রমিকেরা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছেন। টায়ার ও কাঠে আগুন জ্বেলে তাঁরা সড়ক অবরোধ করেন। কাঠগড়ার পাশাপাশি শ্রমিকেরা জামগড়া ও কুটুরিয়াতেও রাস্তায় নামেন। এ সময় সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন শ্রমিক ও পুলিশ সদস্য আহত হন। সাভারে গতকাল পরিস্থিতি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। বন্ধ থাকা স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে গতকাল কাজ হয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরের কালশীর পোশাক শ্রমিকেরাও আজ রাস্তায় নেমে আসেন। এ সময় তাঁরা সড়কের ওপর বসে পড়েন। স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসসহ আশপাশের কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। এতে কালশী রোড ও আশপাশের সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকল্প সড়ক ব্যবহার করে যান চলাচল করতে থাকে। নিরাপত্তার জন্য স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যসহ জলকামান, সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে আসেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঘণ্টাখানেক তাঁর সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা হয়। সকাল পৌনে ১০টার দিকে শ্রমিকেরা ১২ জানুয়ারি শনিবার থেকে কাজে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।

পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইমরানুল হাসান বলেন, নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার আশ্বাসে পর শ্রমিকেরা অবরোধ প্রত্যাহার করেন। অবরোধ তুলে নেওয়ার পর কালশী রোডে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

পুলিশ জানায়, গতকাল সকালে বেরন এলাকার শারমিন গ্রুপের এএম ডিজাইন কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি দিয়ে সড়কে বেরিয়ে আসেন। এ সময় শ্রমিকরা আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ এতে বাধা দেয়।

পরে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ সময় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

শ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণ হলো, সরকার ঘোষিত সর্বশেষ মজুরী কাঠামো অনুযায়ী তাদের বেতন না হওয়া। একই দাবীতে পার্শ্ববর্তী আলফা ফ্যাশন, ফায়াজ গার্মেন্টস ও নূরা ফ্যাশনার এর শ্রমিকরাও রাস্তায় তখন বিক্ষোভ করছে। তবে মিসামিবিটপি এই অশান্তি থেকে মুক্ত। কারণ হিসেবে সেখানকার শ্রমিকরা জানালেন, মালিকপক্ষ বেতন-ভাতা ঠিকভাবেই দিচ্ছেন। এই কারখানার শ্রমিকদের প্রশান্তি ছুঁতে পারেনি পাশাপাশি থাকা অন্য কারখানার শ্রমিকদের, তারা বঞ্চনার কারণে বিক্ষুব্ধ।

বিক্ষোভরত শ্রমিকদের একজনের নাম জাহাঙ্গীর। তিনি জানান, তিনি গত ৮ বছর পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। এখন একজন দক্ষ শ্রমিক বা অপারেটর। কিন্তু তাকে হেলপার হিসেবে আখ্যায়িত করে বেতন দেয়া হয়েছে ৮ হাজার ৬৪ টাকা।

আন্দোলনরত শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী তাদের প্রাপ্য বেতনের বিপরীতে দুই দফা অপব্যাখ্যামূলক বা বঞ্চনামূলক বেতন নির্ধারণ করেছে। মালিকপক্ষের এমন হঠকারী আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবী করেন তারা।

পোশাক শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য নিরসনে পর্যালোচনা কমিটির প্রথম বৈঠকেই মজুরি কাঠামোর মূল সমস্যা চিহিৃত করা হয়েছে। মজুরি কাঠামোর সাতটা গ্রেডের মধ্যে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে মূলত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। মালিক-শ্রমিক ও সরকার- ক্রিপক্ষীয় বৈঠকে এ সমস্যা শনাক্ত করা হয়।

পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো পর্যালোচনার জন্য গঠিত ১২ সদস্যের কমিটির প্রথম সভা বৃহস্পতিবার (১০ জানুয়ারি) বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে শ্রম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কমিটির আহ্বায়ক আফরোজা খান।

বৈঠক শেষে তিনি বলেন, যেহেতু সমস্যা শনাক্ত হয়েছে সেহেতু সমস্যা সমাধান করা যাবে। আগামী রোববার কমিটির বৈঠক আবার বসবে। ওই বৈঠকে চিহিৃত তিনটি গ্রেডের বিষয় সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

তিনি বলেন, কমিটিকে বিষয়টি সমাধানে এক মাসের সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই সময়ের আগেই বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে। সরকার যে শ্রমিকবান্ধব তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের কারও বেতনই কমবে না।

মজুরি কাঠামোর কারণে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে তা নয়, এর পেছনে অন্য ঘটনা রয়েছে যার একটি উদাহরণ উল্লেখ করে আফরোজা খান বলেন, মজুরি কাঠামোর চাইতে বেশি বেতন দেওয়া হয় এমন একটি কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনীতির মূলভিত্তি হচ্ছে গার্মেন্টস খাত। এ খাতকে ধ্বংস করার জন্য একটি চক্র পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। এ কারণে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।

শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, শুধু বেতনই নয়, শ্রমিকরা যেকোনও সমস্যায় পড়লে একটি হটলাইন নম্বর চালু করবে শ্রম অধিদফতর। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সেই নম্বরে ফোন দিয়ে শ্রমিকরা তাদের সমস্যা জানাতে পারবেন। সমস্যার যাতে তাৎক্ষণিক সমাধান হয় তার ব্যবস্থাও থাকবে। নম্বরটি শিল্প অঞ্চলে মাইকিং করে জানানো হবে।

বৈঠকে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শিদীসহ গার্মেন্টস মালিক, শ্রমিক এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা কমিটির ১২ সদস্যের মধ্যে ১০ জন উপস্থিত ছিলেন।

http://www.dailysangram.com/post/360563