১০ জানুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৭:৪৯

ফের সক্রিয় সিন্ডিকেট

হঠাৎ বাড়ছে চালের দাম

দেশের মানুষ যখন নির্বাচন জ্বরে আক্রান্ত। প্রশাসনযন্ত্র ভোট নিয়ন্ত্রণে ব্যাতিব্যস্ত। সে সুযোগে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অসাধু চক্র। হঠাৎ করে প্রতিকেজি চাল ২ টাকা থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ ভোক্তারা। চালের এই মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে প্রশাসন কিছুই জানে না। তবে নতুন খাদ্যমন্ত্রী আজ এ নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, চালের মূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণই নেই। প্রশ্ন হলো তাহলে দাম বৃদ্ধি করলো কারা? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কালো তালিকাভুক্ত মিল মালিকদের ওপর কোনো নজরদারী না থাকায় চালের এই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, মোট চালের দাম সরকারের বেঁধে দেয়া দামের মধ্যেই আছে। ঢাকাতে কেন ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে এটা সরকারের খোঁজ নেয়া উচিত।

ঢাকার খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের মেসার্স আল্লারদান রাইস স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. জানে আলম ভূঁইয়া বলেন, তিন-চারদিন ধরে চালের দাম বাড়তি। রামপুরার ব্যবসায়ী মো. শিপলু বলেন, সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। চালের দাম কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়ে গেছে। বাবুবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। বন্যা, খরা, বৃষ্টি কোন কিছুই হয়নি। সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। তাহলে কেন চালের দাম বাড়বে। চালের দাম বাড়ার যদি কোনো কারণ থাকে তা সিন্ডিকেট। ওরাই হয়তো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত প্রায় এক বছর দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা কিংবা খরা ছিল না। কৃষকও ঘরে নতুন ধান তুলেছেন খুব বেশিদিন হয়নি। এ সময় চালের বাজার অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের চালের বাজার। সারা দেশে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে অন্তত দুই থেকে ছয় টাকা করে পর্যন্ত বেড়েছে। এনিয়ে বিপাকে ক্রেতারা। চালের পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের বস্তায় (৫০ কেজি) ১০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ধানের পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও হঠাৎ বেড়েছে চালের দাম। এদিকে চালের দাম বৃদ্ধিতে বিভিন্ন জেলার চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আজ বৃহষ্পতিবার বৈঠকে বসছেন নতুন নিয়োগ পাওয়া খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এখানে চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হবে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ে চালের দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। পুরোনো সিন্ডিকেট নতুন করে ফের সক্রিয় হচ্ছে। একশ্রেণীর মিল মালিক কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। ফলে বাড়ছে ধান ও চালের দাম। তাই মিল মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন আড়তদাররা।

তবে মিল মালিকদের একটি পক্ষের দাবি চালের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামের মধ্যেই চাল বিক্রি হচ্ছে। আর ব্যবসায়ীদের একপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে চালের দাম কমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কারণ বর্তমানে ধান বা চালের কোনো ঘাটতি নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মান ভেদে ধানের দাম মনে বেড়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। আর চালের দাম ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে নতুন বছরে কেজিতে ধানের দাম বেড়েছে আড়াই থেকে তিন টাকা। আর চালের দাম কেজিতে বেড়েছে দুই থেকে ছয় টাকা।
বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিন থেকে চালের দাম বাড়া শুরু হয়।

বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে ভালো মানের মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা, যা নির্বাচনের আগে ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা। সে হিসাবে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে বেড়েছে চার থেকে ছয় টাকা। তবে সব থেকে বেশি বেড়েছে মাঝারি মানের চালের দাম। বর্তমানে মাঝারি মানের চাল বি আর-২৮ ও লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজি, যা আগে ছিল ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ নতুন বছরে মাঝারি মানের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ছয় টাকা।

নির্বাচনের আগে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। এ হিসাবে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে চার টাকা।

চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ঝিনাইদহের ডাকবাংলার একটি চাতালে কাজ করা মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন ধরেই ধানের দাম বাড়তি। সব ধরনের ধানের দাম মণে ১০০ থেকে ১২০ টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার এই প্রভাব পড়েছে চালের দামের ওপরে।

ঢাকার খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের মেসার্স আল্লারদান রাইস স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. জানে আলম ভূঁইয়া বলেন, তিন-চারদিন ধরে চালের দাম বাড়তি। এই ব্যবসায়ী বলেন, নির্বাচনের আগে ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি করেছি ২৬০০ থেকে ২৬৫০ টাকা। এখন সেই চাল ২৭৫০ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। ১৯৫০ টাকা বিক্রি করা বি আর-২৮ চালের বস্তা এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ২২৫০ টাকা। এভাবে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।

রামপুরার ব্যবসায়ী মো. শিপলু বলেন, সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। দুই-তিনদিনের মধ্যে সব ধরনের চালের দাম কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়ে গেছে। হঠাৎ কি কারণে যে চালের দাম এমন বাড়লো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবুবাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

চালের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। বন্যা, খরা, বৃষ্টি কোন কিছুই হয়নি। সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। তাহলে কেন চালের দাম বাড়বে। চালের দাম বাড়ার যদি কোনো কারণ থাকে তাহলো সিন্ডিকেট। মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, চালের দাম স্বাভাবিক করতে হলে মিল মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সেই সঙ্গে বাজারে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।

চালের দাম বাড়ার জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল আজিজ। পাবনার ঈশ্বরদীর রোজ এগ্রো প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক আবদুল আজিজ বলেন, নির্বাচনের কারণে সরবরাহে কিছু সমস্যা হয়েছিল, যে কারণে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে চালের দাম কমে যাবে। ইতোমধ্যে আমরা হাসকি চালের দাম বস্তায় প্রায় ২০০ টাকা কমিয়ে দিয়েছি। ঢাকার বাজারে দাম কমতে হয় তো দুই-একদিন সময় লাগবে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, মোট চালের দাম সরকারের বেঁধে দেয়া দামের মধ্যেই আছে। কোন জেলাতেই মোটা চালের কেজি ৩৬ টাকা পার হয়নি। ঢাকাতে কেন ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে এটা সরকারের খোঁজ নেয়া উচিত।

তিনি বলেন, আগের থেকে এখন হয় তো চালের দাম একটু বাড়ছে। এটা স্বাভাবিক। চালের দাম কমে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক ছিল। এখন কিছুটা দাম বেড়ে সেটা সমন্বয় হয়েছে। আর মিনিকেট চালের দাম বাড়া এটা কোনো বিষয় না। এ নিয়ে সরকারেরও কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ মিনিকেট চাল বছরে একবার হয়। এখন মিনিকেট চাল শেষ হয়ে আসছে। সুতরাং এক-দুই টাকা করে বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এ চাল খাওয়ার মানুষ আলাদা। সাধারণ মানুষ এই চাল খায় না।

নওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ধানের বাজার মন্দা ছিল। সরকার ৩৬ টাকা কেজি দামে চাল সংগ্রহ শুরু করার পর ধানের বাজার ‘একটু চাঙ্গা’ হয়েছে। এর ফলে মিলগুলোতে চালের দামও কিছুটা বেড়েছে। আগামী কিছু দিন চালের এই দাম চলবে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।

এদিকে পাইকারী বাজারে দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে চট্রগ্রামের পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজাম উদ্দিন বলেন, মিলমালিকরা হঠাৎ চাল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন, যদিও সরবরাহ কমে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। মিলমালিকরা ধানের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে চালের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। যে হারে চালের দাম বেড়েছে, সেই অনুপাতে কিন্তু ধানের দাম বাড়েনি। কারণ, কৃষকের ঘরে নতুন ধান উঠেছে খুব বেশি দিন হয়নি।

গত ১ ডিসেম্বর থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয় লাখ টনেরও বেশি আমন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, এবার আমন চালের উৎপাদন খরচ পড়েছে সাড়ে ৩৪ টাকা। বাজার পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে, খোঁজ-খবর নিয়ে মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

নতুন করে মজুদ শুরুর আগে সরকারি গুদামে চাল ও গমসহ ১২ লাখ ১৮ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ ছিল, যার মধ্যে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন ছিল চাল।

এর আগে চালের দাম খুব বেশি বেড়েছিল ২০১৭ সালের মধ্যভাগ থেকে কয়েক মাস ধরে। ওই বছর এপ্রিলে আগাম বন্যায় হাওরের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে চালের দাম বাড়তে শুরু করে।

সে সময় সরু চালের দাম খুচরায় কেজি প্রতি ৭০ টাকা পর্যন্ত ওঠে, সমানতালে বাড়ে মোটা চালের দামও। পরে নতুন ধান ওঠায় চালের দাম কমে আসে।#

https://www.dailyinqilab.com/article/178310/