১০ জানুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৭:৩১

গণতান্ত্রিক সমাজ আর কত দূর

৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রশ্ন। রাজনীতিবিদদের মধ্যে চলছে বিভিন্ন বিষয়ে নানা মাত্রায় বিতর্ক। এবার এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ জাতিসংঘ। এ সব ঘটনার ব্যাপারে দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি প্রত্যাঘাতমূলক সহিংসতা ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব সংস্থাটি। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি ৪ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, সংসদ নির্বাচনে শুধু ভোটগ্রহণের দিনই প্রাণহানি এবং বেশকিছু মানুষের আহত হওয়ার বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গেছে। আর দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, প্রত্যাঘাতমূলক কর্মকা- অব্যাহত আছে; বিশেষত রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের বিরুদ্ধে। এ সব কর্মকা-ের মধ্যে রয়েছে শারীরিকভাবে হামলা ও নির্যাতন, বাছ-বিচারহীনভাবে গ্রেফতার, গুম ও ফৌজদারি মামলা দায়ের ইত্যাদি। বিভিন্ন খবরে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সহিংস আক্রমণ করছেন এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।

জাতিসংঘের উদ্বেগ প্রকাশের চিত্রে আরো বলা হয়, গণমাধ্যম পেশাজীবীদের ভয়ভীতি দেখানো, তাদের আহত করা, সম্পদের ক্ষতিসাধন ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মতো অস্বস্তিকর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া এমন প্রবণতাও দেখা গেছে, যাতে নির্বাচন নিয়ে অবাধে ও প্রকাশ্যে প্রতিবেদন করা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে কমপক্ষে ৫৪টি নিউজ পোর্টাল ও অন্য ওয়েবসাইট বন্ধ এবং ভোটগ্রহণের দিন ঘিরে ইন্টারনেট সেবায় অস্থায়ী বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রেস ব্রিফিংয়ে আরো বলা হয়, মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করেন এমন সব ব্যক্তি ও সংগঠন, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যকার আগ্রহী ব্যক্তিদের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্র সীমিত হচ্ছে।

নতুন নির্বাচনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ পুলিশ কর্তৃক ছত্রভঙ্গ করে দেয়া, আবারও গ্রেফতার এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইনের অধীনে মামলা দায়েরের খবরও আসছে। এই আইনসহ স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে এমন আইনের সংস্কার করা উচিত- যাতে মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও জনসাধারণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের অবাধে বিতর্ক করার অধিকার সুরক্ষিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব প্রস্তাব ক্ষমতাবানরা আদৌ আমলে নেবেন কী? না নিলে প্রিয় স্বদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?

ভোটের কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবার বাংলাদেশে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। ৪ জানুয়ারি বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোট’ মানববন্ধন করেছে। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা বক্তব্য রাখেন। বক্তারা বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কতটা নিষ্ঠুর, এই ঘটনা তার প্রমাণ। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে- এটা এখন সবার প্রত্যাশা। প্রতিপক্ষকে ভোট দেওয়ার কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে পারে এটা কল্পনা করা যায় না।

স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ধর্ষককে আড়াল করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। তিনি বলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের যারা ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার। বক্তারা আরও বলেন, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অপরাধের বিচার পান না। ফলে অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি হয়। সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে না।

সুবর্ণচরের ঘটনায় দলমত নির্বিশেষে সবাই এখন সোচ্চার। এমন ঘটনায় মানুষ সোচ্চার না হলে সমাজে মানুষের বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠবে। ভাবতে অবাক লাগে, যারা রাজনীতি করে তারা কী করে সংঘবদ্ধ হয়ে নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে। তাদের তো উচিত ছিল নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় এগিয়ে আসা। তাই প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের জন্য কি এখন আর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক কোনো কর্মসূচির আয়োজন করা হয় না? কর্মীদের কাজ কি শুধু ভোটের সংখ্যা বাড়ানো ও প্রতিপক্ষের লোকজনদের হেনস্তা করা? অথচ ভোটের সময় দেশ সেবা ও জনসেবার খৈ ফোঁটে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মুখে। ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়ায় প্রচারের পর এখনতো দলীয় পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, মুখ রক্ষার পদক্ষেপের পাশাপাশি আরও অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জন্য। সেগুলো অবশ্যই হতে হবে আদর্শিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে। নইলে ভবিষ্যতেও আমাদের আফসোস করে বলতে হবে, প্রতিপক্ষকে ভোট দেয়ার কারণে এ দেশে নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়!

আমাদের এই উপমহাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা কতটা হচ্ছে তা এক প্রশ্নবোধক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের আগে এবং পরে যেমন এ বিষয়ে কথা হয়, তেমনি কথা হয় সরকারের দমন অভিযানের সময়ও। বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ বলেছেন, ভারতে ধর্মের নামে ঘৃণার প্রাচীর তোলা হচ্ছে এবং যারাই এর বিরোধিতা করছেন তারাই অবিচার ও শাস্তির শিকার হচ্ছেন। এক ভিডিও বক্তব্যে শাহ এই মন্তব্য করেন। অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া তার এই বার্তা প্রকাশ করেছে।

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ভারত সরকার এনজিওর বিরুদ্ধে দমন অভিযান শুরু করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচডগ এই দমন অভিযানের বিরোধিতা করে। নাসিরুদ্দিন শাহ তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, যারাই অধিকার দাবি করছেন তাদেরকেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, বুদ্ধিজীবী, কবি সবার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের কণ্ঠস্বরও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ধর্মের নামে ঘৃণার প্রাচীর খাড়া করা হচ্ছে। নিরপরাধ লোকদের হত্যা করা হচ্ছে। দেশে ভয়াবহ ঘৃণা ও নৃশংসতার জোয়ার বইছে। শাহ বলেন, ভারত এ কোন্্ পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে? আমরা কি এমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম যেখানে ভিন্ন মতালম্বীদের কোনো স্থান থাকবে না। কেবল ধনী আর ক্ষমতাবানদের কথাই শোনা যাবে এবং গরিব, অসহায় ও দুস্থ লোকেরা কেবলই নির্যাতনের শিকার হবে? এক সময় যেখানে আইনের শাসন ছিল, এখন সেখানে কেবলই অন্ধকার।

ভারতের সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেশ সুন্দর করে কথা বলেন। আবেগের সাথে তারা শান্তি ও সহিষ্ণুতার বাণী উচ্চারণ করে থাকেন। তারা এ কথাও প্রচার করে থাকেন যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার দেশ। কিন্তু এমন প্রোপাগা-ার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির মিল কতটুকু? নাসিরুদ্দিন শাহসহ আরও অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আজ কেন প্রশ্ন তুলে বলছেন, এ কোন্ পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে ভারত? যে দেশে গরুর চাইতে মানুষের মূল্য কম, সে দেশ কেমন করে মানবিক ও গণতান্ত্রিক চেতনার দেশ হয়?

আমাদের উপমহাদেশে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশটির পরিবেশ-পরিস্থিতি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে প্রভাব ফেলে থাকে। তাই আমরা চাই, প্রকৃত অর্থেই ভারত হয়ে উঠুক একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ।

http://www.dailysangram.com/post/360490