২৭ নভেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৬:২৫

মহেষপুর সীমান্ত দিয়ে গত ১ মাসে চার শতাধিক মানুষকে জোর পূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ

বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার মহেষপুর সীমান্ত দিয়ে গত ১ মাসে চারশতাধিক মানুষকে জোর পূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আজ ২৭ নভেম্বর প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, “গত এক মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার মহেষপুর সীমান্ত দিয়ে কয়েক কিস্তিতে প্রায় চারশত পুরুষ-মহিলা ও শিশুকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনায় আমি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। এ ঘটনায় বাংলাদেশের সচেতন জনগণ সকলেই উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত।

ভারতে তথাকথিত অবৈধ নাগরিক তালিকা তৈরি এবং ভারতের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া নাগরিক বিশেষ করে মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি প্রদানের পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে বিষয়টির প্রতি নজর রাখছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশে জোরপূর্বক যে সব লোককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের বিজিবি আটক করেছে। বিজিবির কর্মকর্তাগণ তাদের ভারত থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মহেষপুর থেকে বিজিবির সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়ান অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল আহসান বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, ‘ভারতের এনআরসির ভয়ে সেখানকার লোকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে। বিজিরি হাতে আটক হওয়া লোকদের প্রায় সবাই মুসলমান। আটক লোকদের কাছে কোন দেশের পাসপোর্ট না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা দিয়ে তাদের জেলে পাঠানো হয়েছে। তারা বাংলাদেশের নাগরিক কিনা সে ব্যাপারে তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। সে জন্য বিজিবি তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই দেখছে।’ চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবির পরিচালক মোঃ খালেকুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান যে, ভারতের এনআরসির জটিলতার কারণে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়েও ভারতীয়দের বাংলাদেশে পুশইন করা হচ্ছে।

মহেষপুর উপজেলার ইউএনও’র দায়িত্বে থাকা সুজন সরকার বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘বিজিবির অনুরোধে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য গ্রামে গ্রামে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ ভারতের মানবাধিকার সংগঠন কর্মকর্তা ও কর্মীগণ বিবিসিকে বলেছেন যে, ‘ভারতের নানা প্রান্ত থেকে অবৈধ বাংলাদেশী সন্দেহে আটক নারী-পুরুষদের দলে দলে কলিকাতায় নিয়ে এসে গোপনে এবং জোর করে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়া হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পুলিশ তাদের বিএসএফের হাতে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা ত্যাগ করে তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে।’ পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি বা এপিডিআরের সাধারণ সম্পাদক ধীরাজ সেনগুপ্ত বিবিসিকে বলেছেন, ‘তথাকথিত বাংলাদেশীদের জোর করে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারে যা ঘটছে তা অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।’ ভারতীয় মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে, ‘তাদের যেন কিছুতেই বিএসএফ-এর হাতে তুলে না দেয়া হয়।’ ভারতের একজন সাবেক মানবাধিকার কর্মকর্তা অরিজিৎ সেন বিবিসিকে বলেছেন যে, তিনি মনে করেন ‘১৯৪৬ সালের ফরেনার্স এ্যাক্ট অনুসারে এরা যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয়েও থাকে তাহলে ব্যাপারটি আদালতে পেশ করে তারা যে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে সেটা আগে ভারত সরকারের প্রমাণ করা দরকার। তারপরে অন্য ব্যবস্থা। কিন্তু ভারত সরকার সেই প্রস্তুতির ধারে কাছেও যাচ্ছেনা। আর ভারতের সরকার, পুলিশ ও বিএসএফ এ বিষয়টি সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। তারা কিছুই বলছে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ.কে আব্দুল মোমেন গত ২৬ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভারত থেকে পুশইনের বিষয়ে সরকারীভাবে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন। এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতের নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদ পড়া লোকদের পুশইন করা হবে না বলে আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর হচ্ছে না।

অপরপক্ষে ঝিনাইদহ জেলার মহেষপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ রাশেদুল আলম বিবিসিকে বলেছেন ‘আটক ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিক বলে তারা তদন্তে প্রমাণ পেয়েছেন। সে কারণে তারা এটাকে অনুপ্রবেশ হিসেবে দেখছেন না।’ মহেষপুর থানার ওসি মোঃ রাশেদুল আলমের এবং বিজিবির কর্মকর্তাদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে বাংলাদেশে জনমনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বিভ্রান্তি ও ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পুশইনের ব্যাপারে যেখানে কিছুই জানেন না, সেখানে মহেষপুর থাকার ওসি এ ব্যাপারে বক্তব্য দেয়ার কে? তিনি কি সরকারের মুখপাত্র? প্রায় ১ মাস যাবত ভারত থেকে লোকদের বাংলাদেশে পুশইন করা হচ্ছে। তিনি এতদিন কেন এ ধরনের বক্তব্য দেননি? অথচ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশইনের অপচেষ্টা চলছে। তাই আমরা আশা করি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার লুকোচুরি খেলা বন্ধ করে জাতির সামনে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে সঠিক তথ্য প্রদান করে জনমনে সৃষ্ট ধূম্রজাল ও বিভ্রান্তি নিরসন করবে।

ভারতীয় লোকদের বাংলাদেশে পুশইনের ঘটনা বন্ধ করার লক্ষ্যে ভারত সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আমি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”