১ মার্চ ২০২১, সোমবার

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে জামায়াতের আমীর

হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে ঐক্যবদ্ধ হই- ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, বিগত ৫০ বছরেও জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেনি। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কঠিন। দুর্ভাগ্যের বিষয় জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে দেশে অনৈক্য বিভেদ বিভাজন ও বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। তিনি বলেন, এদেশে যেসব সমস্যা বিরাজমান সেগুলোর সমাধান সকলে মিলে করতে হবে। এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের শপথ হবে ‘বিভেদ নয় ঐক্যের’ মাধ্যমে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও শত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে রাজপথে প্রতিবাদ মুখর থেকেছে। আগামী দিনেও সবাইকে সাথে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী দেশ গড়ার রাজনীতি অব্যাহত রাখবে ইনশাআল্লাহ। তাই ক্ষমতাসীনসহ সকল রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রতি আমাদের আহবান, আসুন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করি। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে গিয়ে দেশের আলেম-ওলামা, শিক্ষক-সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক ও সকল শ্রেণী-পেশার মানুষসহ সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হই। সুখী সমৃদ্ধশালী ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ গঠনে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাই।

আজ সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেশবাসীর উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, আ.ন.ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, কেন্দ্রীয় প্রচার সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুর রব, শাহাবুদ্দিন, ইজ্জতুল্লাহ, মোবারক হোসেন, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ, শিক্ষাবিদ প্রফেসর কুরবান আলী, ড. খলিলুর রহমান মাদানী, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর মঞ্জুরুল ইসলাম ভূইয়া, সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, মহানগরী উত্তরের নায়েবে আমীর আবদুর রহমান মুসা, সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম, মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল জাব্বার, মহানগরী উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল রাশেদুল ইসলাম প্রমুখ।

বক্তব্যের শুরুতে বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৫০তম বর্ষে পদার্পণের সুযোগ পেয়ে তিনি মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে লাখো শুকরিয়া আদায় করেন। সেই সাথে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির শুভ মুহূর্তে তিনি প্রিয় দেশবাসীকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানান। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে পদার্পণের এই মুহূর্তে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল শহীদ ও সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের বীরত্ব, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিশেষভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার, জনগণের মৌলিক অধিকার বিশেষ করে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ও দেশ গড়ার কাজে যারা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন আমি তাদের সকলকে স্মরণ করছি।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিলখানায় স্বাধীনতার-সার্বভৌমত্বের অতন্ত্রপ্রহরী আমাদের সেনাবাহিনীর যে সব অফিসারগণ নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন, তিনি ঐসব বীর সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তাদের পরিবার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমীরে জামায়াত ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলীকে যারা ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাদের শাহাদাত কবুল করুন। সেই সাথে স্মরণ করেন, শায়খুল হাদীস মাওলানা এ কে এম ইউসুফ ও পাঁচ বারের নির্বাচিত সাবেক এমপি হযরত মাওলানা আবদুস সুবহানসহ যারা দীর্ঘদিন সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারেই ইন্তিকাল করেছেন। তিনি আরও স্মরণ করেন, অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমাদকে; যিনি দীর্ঘদিন নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

তিনি শ্রদ্ধার সাথে আরও স্মরণ করেন, বিশ্ব বরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন ও সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে যারা সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর যাবত কারাগারে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

তিনি বলেন, সারা দেশে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে মাসের পর মাস জেলখানায় আটকিয়ে রাখা হয়েছে। বহু সংখ্যক নেতা ও কর্মীকে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শতশত নেতা-কর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে অনেককে পঙ্গু করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে অসংখ্য নেতা-কর্মীকে। গুম হওয়া ব্যক্তিদেরকে পরিবারের কাছে অবিলম্বে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ বিরোধী দলের সকল নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাবি করেন।

জামায়াতের আমীর বলেন, দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। রচিত হয় সংবিধান- রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ আইন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যাশা ছিল তারা তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার ভোটাধিকার পাবে, ইজ্জত ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি পাবে, সভা-সমাবেশ, চলাফেরা ও কথা বলার অধিকার পাবে। দুঃখের বিষয় আমরা সবকিছু হারাতে বসেছি।

৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একথা অনস্বীকার্য যে বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। একটি পতাকা। আমাদের সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ বাহিনী সারা বিশ্বে দেশের সুনাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে। সীমান্ত রক্ষায় বিজিবির সাহসী ভূমিকা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জনগণের শক্তি ও সাহসকে আরও দৃঢ় করেছে। শান্তি মিশনে সশন্ত্র বাহিনী ও পুলিশের ভূমিকা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে।

তিনি বলেন, জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় শিল্প ব্যবসা, বাণিজ্য, ব্যাংক বীমা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধি ঘটেছে। জনগণের অর্থে অবকাঠামো রাস্তাঘাট- ব্রীজ কালভার্ট বিশেষ করে যমুনা, মেঘনা, গোমতী, বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের উপর সেতু নির্মাণ অর্থাৎ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। রাজধানীর সাথে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনকারী সেতু পদ্মা আজ দৃশ্যমান। রাজধানীর সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর সাথে আকাশ পথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শিল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গণের বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের কোটি জনতা বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক গতি সঞ্চার করেছে। মালিক ও শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গার্মেন্টস শিল্প অর্থনীতির প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে।

রাজনৈতিক অধিকারের অনিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, উল্লেখিত অর্জনগুলোর পাশপাশি ৫০ বছর পূর্তির শুভ লগ্নে আমরা আমাদের অবস্থানের নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই অর্ধ-শতাব্দীর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ একটি অধিকার হারা জাতিতে পরিণত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু কার্যত দেশ আজ গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ব্যক্তির অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে তার জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। সরকার সংবিধানের প্রতি অনুগত থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। বর্তমান সরকার সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের বিভাজনের রাজনীতি ও প্রতিহিংসার কারণে দেশে বিরাজ করছে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার, ভোটের অধিকার, ইজ্জত ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার, কথা বলার অধিকার এক কথায় মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ নেই। মানুষের মৌলিক অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। মিছিল-সমাবেশসহ সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি কার্যত নিষিদ্ধ। স্বাধীনতার ৫০ তম বর্ষে পদার্পণের মুহূর্তে জনগণের নিকট এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার অর্জনের নিশ্চয়তা।

নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিজেদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের জনগণ অনেক আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছে। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের ফলে নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সকল দলের সম্মতিতে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার তা বাতিল করে দেয়। আজ বাংলাদেশে নির্বাচনের কোন পরিবেশ নেই। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, ব্যালট বক্স ছিনতাই, আগের রাতেই ভোট প্রদানসহ ভোট ডাকাতির নানাবিধ ঘটনা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আর কোন আগ্রহ নেই, গণতন্ত্রের জন্য এটি অশনি সংকেত। ৫০ বছর পূর্তির বর্ষে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে তা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।

ডা: শফিকুর রহমান বলেন, দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিগত ৫০ বছরেও জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেনি। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ছাড়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা কঠিন। দুর্ভাগ্যের বিষয় জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে দেশে অনৈক্য, বিভেদ-বিভাজন ও বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য দল-মত-নির্বিশেষে সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজও জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেনি।

রাজনীতিতে এখনো অপরের মতকে সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানোর মানসিকতা গড়ে উঠেনি। প্রতিহিংসা, ঈর্ষা, পরস্পরকে দোষারোপ, নির্মূল, উৎখাত ও উচ্ছেদের রাজনীতি জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে। জোর করে ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় থাকার মানসিকতার কারণে বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করার মনোবৃত্তি দেশকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। দেশ গঠনে যার যতটুকু অবদান তার স্বীকৃতি দেয়ার পরিবর্তে শুধুমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হওয়ার কারণে তার স্বীকৃতি দেয়া হয় না। জ্ঞানী-গুণীদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শণের পরিবর্তে তাদের প্রতি কটাক্ষ করে মত পার্থক্যের ব্যাপ্তিকে আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে সরকার ও বিরোধীদল একে অপরের পরিপূরক। গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধীদল অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিরোধী দলের বিকাশ ও তৎপরতাকে সরকারের জন্য হুমকি মনে করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আদর্শ চরিত্রবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিগত ৫০ বছরেও জাতীয় আদর্শ ও আপামর জনগণের বিশ্বাস এবং চেতনার ভিত্তিতে কোন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে আদর্শহীন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জীবনে ঊষালগ্নেই নৈতিকতাবোধ অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনৈতিক ক্যাডার বাহিনীর বিচরণক্ষেত্র বানানো হয়েছে। শিক্ষা, গবেষণার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ সরকারী ক্যাডারদের টর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ৫০ বছরের মধ্যে দেশের শিক্ষাঙ্গণগুলোতে হল দখল, সীট দখল, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজীসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মতের ছাত্রদেরকে হত্যা, খুন, নির্যাতন শিক্ষাঙ্গণের পবিত্র পরিবশেকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, দক্ষতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়ায় শিক্ষার গুণ ও মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জামায়াত আমীর বলেন, যে দেশের বীর সন্তানেরা ‘কথা বলার স্বাধীনতা’ অর্জনের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল, সে দেশে স্বাধীন মত প্রকাশ ও কণ্ঠরোধ করার জন্য বারবার অপচেষ্টা চালানো হয়। সংবাদপত্র ও মিডিয়ার উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হয়। সরকার মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ জাতীয় সংসদে পাস করে। সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ, সকল বিরোধী দল ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ আইন পাস না করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। সকলের মতামত অগ্রাহ্য করে আইনটি পাস করা হয়। মত প্রকাশের কারণে জেলে আটক রাখার মানবাধিকার পরিপন্থী এই আইনের মাধ্যমে সংবাদ কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের নির্যাতনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসার অধিকার মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে স্বাস্থ্য খাত ভয়াবহ বিপর্যয়ে নিপতিত। কোভিড-১৯ এর কারণে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির খণ্ড চিত্র জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। প্রকৃত চিত্র অনেক ভয়াবহ। বিগত ৫০ বছরেও সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দ্য প্যাসিফিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জিডিপির বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন দুর্নীতির কারণেই স্বাস্থ্য খাতের করুণ অবস্থা। সরকারের অনীহা, অদক্ষতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা উপকরণ না থাকায় করোনা ভাইরাসে চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবা নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীগণ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হন। করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি করে মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জামায়াতের আমীর বলেন, স্বাধীনতার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। আজ অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে মানুষের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই। মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অপরাধ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। হত্যা-খুন-গুম-অপহরণ-নারী-শিশু নির্যাতন ও বিচার বহির্ভূত হত্যার শংকায় গোটা জাতি উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠিত। দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধ দমনের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলসমূহকে দমনের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের কারণে পুলিশের মধ্যে পেশাদারিত্বের পরিবর্তে অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকরূপ লাভ করেছে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা মাদক সেবনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই গ্রেফতার বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। পেশাদারিত্বের পরিবর্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে ধর্ষণ আজ ভয়ঙ্কররূপ লাভ করেছে। শিক্ষাঙ্গণে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে দিবালোকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। চলন্ত বাসে ধর্ষণ, চিকিৎসা করতে গিয়ে নারী ধর্ষণের শিকার, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, মা ও মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ, প্রতিবন্ধী ধর্ষণ, পিতার সামনে কন্যাকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদেরকে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ৫/৬ বছরের শিশু থেকে শুরু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধাও রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণের কবল থেকে।


তিনি বলেন, সরকারের ছত্রছায়ায় ও আশকারায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কোন সদস্য অতি উৎসাহী হয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। অবসর প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এ নির্মমতার শিকার হচ্ছেন। আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত দাগী খুনীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করে দেয়ায় অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জামায়াত আমীর বলেন, জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্রই একটি গতির সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ও স্বার্থান্বেষী চক্রের অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা একটি দুর্নীতিবাজ চক্র গড়ে উঠে। যাদের কারণে শেয়ারবাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। ব্যাংকসমূহ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। ডেসটিনি, হলমার্ক, কেসিনো কেলেঙ্কারী অর্থনীতিতে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বিদেশে মানব পাচার, মুদ্রা পাচার দেশের অর্থনীতিতে যেমন বিপর্যয় ডেকে এনেছে তেমনি বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে। দেশে পণ্য আমদানির নামে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে, আবার বিদেশে পণ্য রপ্তানির প্রচুর অর্থও দেশে আসছে না। দেশে ঋণ জালিয়াতি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ঋণ ব্যবহারে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলো দায়-দেনা ও লোকশানের পরিমাণ লাখ লাখ কোটি টাকা। এসব সংস্থা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করে না। তাদের রাজস্ব দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় সমপরিমাণ। মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আমাদের সংসদ সদস্য বিদেশের আদালতে দোষী সাব্যস্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় আমাদের দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

জামায়াত আমীর বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় বাংলাদেশের মানুষের কষ্টে অর্জিত রিজার্ভ ফান্ডের টাকা চুরির ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। যা সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছে। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে যায়। এ ঘটনার জন্য দায়েরকৃত মামলার তদন্তের জন্য ৪৬ বার সময় নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি।

তিনি বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দলীয় লোকদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-আত্মসাৎ, মদ-জুয়া, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ দেশের অর্থনীতির গতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং অসাধু সরকারি কর্মকর্তারা লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। যা দেশের গোটা অর্থনীতির জন্য এক অশনি সংকেত। দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণ। দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান অন্তরায়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সময় ১৮০টি রাষ্ট্রের মধ্যে দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম।

কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে জামায়াতের আমীর বলেন, বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আবহমান কাল থেকে কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের পাটকে একসময় সোনালী আঁশ বলা হতো। পাট রপ্তানী করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো। সরকারি অবহেলা, অব্যবস্থাপনায় সেই পাট শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একে একে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সকল পাটকল ও চিনিকল। তিনি বলেন, বেসরকারি উদ্যোগে মৎস্য, পোল্ট্রিসহ কৃষিভিত্তিক শিল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অথচ আজ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। আজও কৃষকগণ ন্যায্য মূল্যে সার, কীটনাশক পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নির্ধারিত না হওয়ায় সম্ভাবনাময় কৃষি খাত অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলতে গেলে কোন বাজার ব্যবস্থাপনাই গড়ে উঠেনি।

বিচারাঙ্গণ নিয়ে ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ন্যায় বিচার পাওয়া নাগরিকদের জন্মগত অধিকার। দুঃখের বিষয় ন্যায় বিচার পাওয়া তো দূরের কথা গোটা বিচারাঙ্গণের অবস্থা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মেধা ও যোগ্যতা দেখে আজ বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। সরকার তার ইচ্ছামত আদালতকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। তার ব্যতিক্রম হলেই সরকারের রোষানলে পড়তে হচ্ছে বিচারকদের। নিম্ন আদালতগুলো আজ সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশ নিম্ন আদালত অনুসরণ করছেন না। বিনা বিচারে দিনের পর দিন কারাগারে বন্দী জীবন-যাপন করছেন অনেক নিরীহ মানুষ। তিনি বলেন, ২০ বছর কারা ভোগের পর অনেককে নির্দোষ ঘোষণা করেছে উচ্চ আদালত। বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। রাজনৈতিক বিষয়সমূহ আদালতে টেনে নিয়ে বিচারাঙ্গনকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার নজীরবিহীন ঘটনাই প্রমাণ করে বিচারাঙ্গণের চরম দুরবস্থার কথা। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনুপস্থিত।

অপসংস্কৃতির সয়লাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ আজ অবহেলিত। সংস্কৃতির নামে বিদেশী অপসংস্কৃতিকে জোরপূর্বক জাতির ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। বিদেশী চলচিত্র, শর্টফিল্ম, ওয়েব সিরিজ, অশ্লীল ছায়াছবি আমাদের যুব সমাজের চরিত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তার প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার বাস্তব প্রমাণ মাদকাসক্তি, খুন, গুম ও ধর্ষণসহ নির্বিচারে পিটিয়ে মানুষ হত্যা।

সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে জামায়াত আমীর বলেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকাটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু বিগত ৫০ বছরে ভারতের সাথে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুরই সমাধান হয়নি। ভারতীয় সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। বিগত ৫০ বছরে এমন কিছু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে যা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা করেছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি বিএসএফ সীমান্তে গুলি করে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর লাশ। সেই বর্বর দৃশ্য আজও দেশের মানুষকে ব্যথিত করে। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতের সাজানো বিচারে বিএসএফের হত্যাকারীরা সব বেকসুর খালাস পেয়েছে। সীমান্তে বিএসএফের এমন বর্বর আচরণের কড়া প্রতিবাদ কখনো বাংলাদেশের তরফ থেকে করা হয়নি। বরং বিভিন্ন সময় বিএসএফের সাফাই গেয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এর প্রধান।

জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি অপার সম্ভাবনার একটি দেশ। জামায়াতে ইসলামী এ দেশকে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এ লক্ষ্যেই জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে। জামায়াত তার জন্মলগ্ন থেকেই সুশিক্ষা, আদর্শ নাগরিক তৈরী, নৈতিক চরিত্র গঠন, নাগরিকদের চিকিৎসা সেবা, বেকারত্ব দুরীকরণ ও যুব সমাজের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। জামায়াত দেশ ও জাতির স্বার্থে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। দেশের প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বোপরি জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভূমিকা রেখেছে।

অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ডা: শফিকুর রহমান বলেন, গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে স্বচ্ছ, নিরেপেক্ষ, অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাব জাতির সামনে উপস্থাপন করে।

তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে প্রথম একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়- যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়। জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করার জন্য জাতীয় সংসদে বিল পেশ করে। অনেক আন্দোলন সমগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এই ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রদান করে। গণতন্ত্রের একটি পরিবেশ তৈরী হয়। কিন্তু ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য ২০১১ সালে সরকার জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। মূলত তখন থেকেই রাজনৈতিক সংকটের শুরু।

জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনমুখী দল উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী মনে করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। জামায়াতে ইসলামী অতীতের প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে এবং দশম সংসদ পর্যন্ত প্রতিটি সংসদে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্ব ছিল। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭৯ সালে ৬টি, ১৯৮৬ সালে ১০টি, ১৯৯১ সালে ১৮টি ও ২টি মহিলা আসনসহ ২০টি আসন, ১৯৯৬ সালে ৩টি, ২০০১ সালে ১৭টি আসন ও ৩টি মহিলা আসন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২টি আসন লাভ করে। জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্যগণ জাতীয় সংসদে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে অনন্য নজির স্থাপন করেন। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের জন্য গঠনমূলক ভূমিকা রেখে চলেছে। জামায়াতে ইসলামী মনে করে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন।

জামায়াত আমীর বলেন, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রথম দুই বছর কৃষি ও পরবর্তী তিন বছর শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী আমীরের পরিচালনায় কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। ‘চাষীর বাড়ি বাগান বাড়ি’ প্রকল্পটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে চিনি শিল্প লাভজনক খাতে পরিণত হয়। জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নেতৃত্বাধীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী, ইয়াতীম ও কিশোরদের বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। সততা-দক্ষতা-স্বচ্ছতার সাথে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করে বাংলাদেশে তার এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

বিচার ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে ডা: শফিকুর রহমান বলেন, জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সূচনালগ্ন থেকেই আন্দোলন করে আসছে। জামায়াতে ইসলামী মনে করে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বিচারকদেরকে একমাত্র বিবেকের কাছে জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে বিচারকার্য চালাতে হবে। আইনাঙ্গণে ন্যায়, ইনসাফ ও মানবাধিকার এবং বিচারের সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতে ইসলামী গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে।

স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে তিনি বলেন, মানুষের অন্যতম প্রধান অধিকার হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি। জামায়াতে ইসলামী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর কর্মীগণ নিজ নিজ এলাকায় ভূমিকা রাখছেন। রাজধানী ঢাকা শহরে জামায়াতে ইসলামী স্বাস্থ্য সেবায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। সর্বোচ্চ সামর্থ নিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াত।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যা, ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, সাইক্লোন, সিডর, আমফানসহ প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বন্যা ও মংগা কবলিত এলাকায় জামায়াতে ইসলামী সাধ্যমত ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের লকডাউনের সময় তৃণমূল পর্যন্ত ত্রাণ তৎপরতা ও যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের অনেকের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত, আহত অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত, নৌকাডুবিসহ নানা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের পুনর্বাসনে জামায়াতে ইসলামী সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সামাজিক কার্যক্রম নিয়ে জামায়াত আমীর বলেন, জামায়াতে ইসলামী মানুষের কল্যাণে ভূমিকা পালন অব্যাহত রেখেছে। অসহায় দরিদ্র মানুষের আর্থিক সহায়তা, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, বিয়ে-শাদী, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মশক নিধন অভিযান, রোগীর পরিচর্যা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, মেডিকেল ক্যাম্প, ভ্রাম্যমান স্কুল, মক্তব, টেকনিক্যাল সেবা, বৃক্ষরোপন অভিযান, দুর্যোগকালীন সহায়তা প্রদান, ত্রাণ বিতরণ, মাতৃত্বকালীন সেবা প্রদান ইত্যাদি বিভিন্ন রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে জামায়াতে ইসলামী ভূমিকা পালন করছে।

ইসলামী রাজনীতির বিকাশ প্রসঙ্গে জামায়াত আমীর বলেন, বাংলাদেশের অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করে। এক সময় ‘ইসলামী রাজনীতিকে’ হারাম মনে করা হতো। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক তৎপরতায় দেশের আলেম-ওলামা, ইসলামী ব্যক্তিবর্গ ইসলামের রাজনীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হলে আদর্শিক মানসম্পন্ন নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে হয়। এজন্য জামায়াতে ইসলামীর রয়েছে বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার। জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকায় ইসলামী রাজনীতির বিকাশ ঘটে। গঠনমূলক, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ভূমিকার মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় জামায়াতে ইসলামী। ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা দেশবাসীর মনে আশার সঞ্চার করে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে জামায়াতে ইসলামী আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব তৈরী করছে।

ইসলামী ও জাতীয় ঐক্যের উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী দেশের দেশপ্রেমিক ও সকল ইসলামী দলসমূহ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম-ওলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক, ওয়ায়েজীন, মুফাসসির, মসজিদের ইমাম ও খতিবসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে নিয়ে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ওলামায়ে কেরামকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন রেখে জামায়াতে ইসলামী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আন্তরিকভাবে ভূমিকা পালন করছে। জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত

২০০৬ সালের ওলামা সম্মেলন ও চলমান সময়ে আলেমদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা দেশে ইসলামী ঐক্যের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
যুব সমাজের চরিত্র গঠন উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুবকরাই একটি দেশের চালিকা শক্তি। পৃথিবীর সকল পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছে যুবসমাজ। আমাদের দেশের যুবসমাজকে অন্যায় অশ্লীলতা, নগ্নতা, অপসংস্কৃতির সয়লাব, মাদকের ছোবল থেকে উদ্ধার ও রক্ষার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ সংশোধনীমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামী যুবসমাজের চরিত্র গঠন, নৈতিক প্রশিক্ষণের কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জামায়াতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মজবুত ভূমিকা পালন করছে। দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী কোন পদক্ষেপ নেয়া হলে কিংবা বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্টকারী কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হলে জামায়াতে ইসলামী তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীগণ স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার পদক্ষেপ নিলে জামায়াতে ইসলামী তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখী বাঁধ ও তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ দেয়ার প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গণে জামায়াতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, ইসলামী সংগঠন, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও সরকার এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে বিশেষ করে মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে জামায়াতে ইসলামী প্রতিবাদ জানিয়েছে। দেশে দেশে নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কাশ্মীর, ফিলিস্তিনে মুসলিম গণহত্যা, আফগানিস্তানে বিদেশী আগ্রাসন, বসনিয়া চেচেনিয়ায় মুসলিম নির্যাতন, আলজেরিয়ায় গণহত্যা, আসাম থেকে মুসলিম বিতাড়ন, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস, বার্মায় মুসলিম হত্যা, চীনের উইঘুর মুসলিম নির্যাতনসহ বিশ্বের প্রতিটি ঘটনায় জামায়াতে ইসলামী তার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করেছে। বার্মা থেকে বিতাড়িত মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

অমুসলিমদের অধিকার নিয়ে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী অমুসলিমদের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। জামায়াতে ইসলামী দরিদ্র অসহায় অমুসলিমদের পুনর্বাসন, গৃহ নির্মাণ ও কর্মসংস্থানে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। অমুসলিমদের উপাসনালয় ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি-ঘর যাতে নিরাপদ থাকে সে জন্য জামায়াতে ইসলামীর কর্মীগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ বিশেষ সময়ে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করেছে।

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী সূচনালগ্ন থেকেই সকল প্রকার সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করে আসছে। জামায়াতে ইসলামী সর্বদাই মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দেয়ার চেষ্টা করেছে। বিগত ৫০ বছরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও কর্মীগণ সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সবক্ষেত্রেই আক্রান্ত হয়েছে। উল্টো জামায়াতে ইসলামীর উপর দোষারোপ করা হলে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জাতীয় সংসদে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, যদি প্রমাণিত হয় শিবির আগে হামলাকারী তাহলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। জামায়াতে ইসলামী বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করেছে কোন সন্ত্রাসী ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তে যদি জামায়াতে ইসলামীর কর্মীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয় তাকে আমরা আইনের হাতে সোপর্দ করতে প্রস্তুত। জামায়াতে ইসলামীর চ্যালেঞ্জ কেউ গ্রহণ করতে পারেনি।

দেশ ও মানুষের কল্যাণে জামায়াতে ইসলামীর গঠনমূলক তৎপরতা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সংগঠন পরিচালনা ও গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে আসছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বসবাস করছে। আমরা একটি আদর্শ লালন করি। সেই সাথে ভিন্নমতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। সন্ত্রাস ও চরমপন্থার ঘোরতর বিরোধী আমরা। অমুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার উপাসনালয়, তাদের ঘরবাড়ী, জানমাল রক্ষায় জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা যেনতেন উপায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার পক্ষপাতি নই। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী জনগণের ন্যায় ও যুক্তিসঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন, ত্যাগ-কুরবানীর বিনিময়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শহীদদের চূড়ান্ত কুরবানী, জেল-জুলুম-নির্যাতন এ আন্দোলনকে মজবুত ও বেগবান করেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের সকলের। এদেশে যেসব সমস্যা বিরাজমান সেগুলোর সমাধান সকলে মিলে করতে হবে। এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের শপথ হবে ‘বিভেদ নয় ঐক্যের’ মাধ্যমে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্তে¡ও শত প্রতিক‚লতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে রাজপথে প্রতিবাদ মুখর থেকেছে। আগামী দিনেও সবাইকে সাথে নিয়ে জামায়াতে ইসলামী দেশ গড়ার রাজনীতি অব্যাহত রাখবে ইনশাআল্লাহ।

তাই ক্ষমতাসীনসহ সকল রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রতি আমাদের আহবান, আসুন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করি। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে গিয়ে দেশের আলেম-ওলামা, শিক্ষক-সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক ও সকল শ্রেণী পেশার মানুষসহ সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হই। সুখী সমৃদ্ধশালী ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ গঠনে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাই। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সহায় হোন।

কর্মসূচি ঘোষণা : স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূতি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামীর সকল অধ:স্তন শাখাসমূহকে নিম্নোক্ত কর্মসূচি পালনের তিনি আহবান  জানান। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- 

১. সংগঠনের সর্বস্তরে তৃর্ণমূল পর্যায়ে মিছিল/র‌্যালি করা। 

২. ৫০ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এবং দেশ গঠনে জামায়াতের ভূমিকা আলোচনা ও সেমিনারের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরা। 

৩. স্মারক ও বুকলেট প্রকাশ করা। 

৪. বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উপহার প্রদান এভং অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহ সংস্কার ও নির্মাণে সহযোগিতা প্রদান। 

৫. অস্বচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, সন্তানদের শিক্ষা উপকরণ প্রদান, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা, রোগীর সেবা, করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, কন্যা দায়গ্রস্তদের বিয়ে ও আত্মকর্মসংস্থানে সহযোগিতা প্রদান করা। 

৬. অসহায়, এতিম, পথশিশু ও দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ। 

৭. ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচি পালন করা। 

৮. বছরব্যাপি রচনা, ক্বেরাত, আজান, হামদ-নাত ও দেশাত্মবোধক গান ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। 

৯. ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক বিভাগের মাধ্যমে খেলাধূলা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং এর মাধ্যমে সুস্থ সংস্কৃতি তুলে ধরা। 

১০. দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীদার করেছেন তাদের জন্য এবং প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হেফাজতের জন্য পরম করুনাময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করা।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সকল স্তরের সংগঠনসমূহকে এ কর্মসূচি সুষ্ঠুুভাবে পালন করার জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেন।