পাহাড়ধসে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে গতকাল ১৪৪ এ পৌঁছেছে। রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০৫ জনে দাঁড়িয়েছে, আহত হয়েছেন ৮২ জন। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ২৯ জন, বান্দরবানে ছয়জন, কক্সবাজারে দু’জন এবং খাগড়াছড়িতে দু’জন নিহত হয়েছেন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। বান্দরবানে পাহাড়ধসে নিখোঁজ মা-মেয়ের লাশ গতকাল উদ্ধার করা হয়েছে। খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে পাহাড়ধসে দু’জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ধসে বাবা-মেয়ে নিহত হয়েছেন।
রাঙ্গামাটি সংবাদদাতা জানান, রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড়ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০৫ জনে দাঁড়িয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম থেকে বুধবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানানো হয়। বুধবার দ্বিতীয় দিনে উদ্ধারকর্মীরা আরো ১০টি লাশ উদ্ধার করেন। উদ্ধারতৎপরতা অব্যাহত থাকায় নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
এর মধ্যে রাঙ্গামাটি শহরে চার সেনাসদস্যসহ ৫৮ জন, কাউখালী উপজেলায় ২৩ জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় চারজন ও বিলাইছড়ি উপজেলায় দু’জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৩টি শিশু, মহিলা ৩০ জন, পুরুষ ৪২ জন। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০ জন। আহত হয়েছে ৮২ জন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কয়েকজন চলে গেলেও ৩৯ জন রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
রাঙ্গামাটি জেলাসদরসহ দুর্গত উপজেলাগুলোতে এক হাজার ১০০ সেনাসদস্য উদ্ধারতৎপরতা চালাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার থেকে রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি রিজিয়ন সেনা সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর প্রতিটি ক্যাম্পের সদস্যরা উদ্ধারতৎপরতায় অংশ নিয়েছেন।
উদ্ধারতৎপরতা চলাকালে রাঙ্গামাটি রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম ফারুকের নেতৃত্বে এই উদ্ধারকাজ মনিটর করেন রাঙ্গামাটি সদর জোনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিদোয়ান, রাঙ্গামাটি রিজিয়নের জিটুআই মেজর তানভীর সালেহ্্ ও মেজর রাকিবুল হাসান।
রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক দিদারুল আলম জানান বিভিন্ন গ্রুপে তারা উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। তিনি জানান, দ্বিতীয় দিনে উদ্ধারতৎপরতা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড গরমে মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। তার পরও লাশ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
এ দিকে গতকাল সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এর আগে তিনি সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের জানান, রাঙ্গামাটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন ও সহায়তায় সরকার সব রকম সহযোগিতা করবে। তিনি রাঙ্গামাটির চট্টগ্রাম সড়কের যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য এবং রাঙ্গামাটি শহরে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মাসুদুর রহমান জানান, বুধবার লাশ এসেছে ১০ জনের। রাঙ্গামাটি শহরে ৮২ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৩৯ জনের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদের ভর্তি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এ দিকে রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২০ পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির মধ্যে রাঙ্গামাটি সদরে ৯০টি, কাউখালীতে ১৯০টি, নানিয়ারচরে ৩০টি বরকলে ৭০টি, চিংমরং, ওয়াগগার রাইখালীতে ৩৪০টি রয়েছে। অন্য দিকে, রাঙ্গমাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই সড়ক, রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
রাঙ্গামাটি শহরে চার দিন ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বাজারে জ্বালানি তেলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘœ ঘটায় টেলিযোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। পানি ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের মাটি ভেঙে পড়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
রাঙ্গমাটি সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন জানান, রাঙ্গমাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শালবন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ৩০ ফুট জায়গা পাহাড়ের নিচে তলিয়ে গেছে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে ১০০ মিটার রাস্তা ৪০ থেকে ৫০ ফুট গভীরে তলিয়ে গেছে।
খাড়া পাহাড় আবার কেটে বাইপাস করে সড়ক তৈরির চেষ্টা করছেন সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগের কর্মীরা। এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আদনান হোসেন জানান, কাউখালী-ঘাঘড়া সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটে রাজার হাট, লিচুবাগান, কারিগর পাড়া রাস্তার ওপর পাহাড়ধসে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
তিন দিনের টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় নি¤œাঞ্চলে জেলার বিলাইছড়ির ফারুয়া, জুরাছড়ি ও বরকলের ভূষণছড়ার নি¤œাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জুরাছড়িতে ৩৩ শতাংশ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।