১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৭:৪৭

কেন কমছে হজযাত্রী

এবার হজের জন্য নিবন্ধনের সময় চার দফা বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু কোটার এক তৃতীয়াংশ ফাঁকাই রয়ে গেছে। এবার সরকারিভাবে ৪ হাজার ২৬০ জন এবং বেসরকারিভাবে ৭৮ হাজার ৮৯৫ জন হজে যেতে নিবন্ধন করেছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের হজে যাওয়ার কোটা বরাদ্দ রয়েছে। দফায় দফায় সময় বাড়িয়েও কোনো কোটা পূরণ হচ্ছে না। এ নিয়ে হজ এজেন্সি, হজযাত্রী ও সরকারি কর্তৃপক্ষের নানা মত রয়েছে। তবে খরচ বেড়ে যাওয়াকেই যাত্রী কমার বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে হজের খরচ বেশি। খরচ বাড়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে হজে যেতে পারছেন না। ধর্ম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়েছে।

পাশাপাশি সৌদি আরবে হজের আনুষঙ্গিক খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে হজ প্যাকেজের খরচ নির্ধারণ করতে হচ্ছে। হজ প্যাকেজের একটি বড় অংশ যায় বিমান ভাড়ায়। সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, নির্ধারিত বিমান ভাড়া অনেক বেশি নেয়া হয়। সাধারণ যাত্রীদের চেয়ে হজ যাত্রীদের বিমান ভাড়া বেশি নেয়া কোনো ভাবেই যৌক্তিক নয়।

এবারের হজ নিবন্ধন শুরু হয় গত ১৫ই নভেম্বর। যা ১০ই ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যাশিত সাড়া না মেলায় সময় বাড়ানো হয় ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে সেই সময় আরও দুই দফায় বাড়ানো হয়। বিশেষ বিবেচনায় চতুর্থ দফায় সময় দেয়া হয় ৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

প্রতি বছরের মতো এবারো সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজে খরচ হবে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা। আর বিশেষ প্যাকেজে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ প্যাকেজে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা এবং বিশেষ প্যাকেজে ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৩০০ টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও আগের বছরের চেয়ে ব্যয় কিছুটা কমিয়ে নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। আগের বছরও বেশি ব্যয়ের কারণে হজের কোটা পূরণ হয়নি। গত বছর কোটার চেয়ে ৬ হাজারের বেশি কম যাত্রী হজে গিয়েছিলেন।

২০২২ সালে সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ ধরা হয়েছিল পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। ওই বছরে হজের খরচ দেড় লাখ থেকে প্রায় দুই লাখ ২১ হাজার পর্যন্ত বেড়েছিল। ২০২০ সালে এই প্যাকেজের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল জনপ্রতি তিন লাখ ৬১ হাজার ৮০০ টাকা।
কোন দেশে কতো খরচ:

গত বছরের ১৬ই নভেম্বর পাকিস্তানের হজ পলিসি ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আগের বছরের তুলনায় এক লাখ রুপি কমিয়ে ১০ লাখ ৭৫ হাজার রুপি খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে দেশটির নাগরিকদের জন্য। ডলারের বিনিময়মূল্যের হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় যা সোয়া চার লাখ টাকার মতো।

ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন হজ কমিটি অব ইন্ডিয়া প্রতি বছর হজ পলিসি ঘোষণা করে।
সংস্থাটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ বছর তারা সর্বনিম্ন যে প্যাকেজ নির্ধারণ করেছে রাজ্য ভেদে সেটি তিন থেকে চার লাখ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা চার থেকে সাড়ে পাঁচ লাখের মধ্যে।

গত বছর ইন্দোনেশিয়া থেকে একজন মুসলমানকে হজে যেতে হলে খরচ করতে হয়েছে তিন হাজার ৩০০ ডলার বা তিন লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ টাকা। আগের বছরের তুলনায় এই খরচ বেড়েছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। দেশটির সরকারি ‘হজ ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’ তহবিল থেকে হজ যাত্রীদের খরচে ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে।

মালয়েশিয়ায় যেসব পরিবারের মাসিক আয় ৯৬ হাজার টাকার কম, সেইসব পরিবারের সদস্যদের জন্য গত বছর সরকারিভাবে হজের খরচ ধরা হয়েছিল দুই লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা। মাসিক আয় এর বেশি হলে দিতে হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। তবে, বেসরকারি হজ প্যাকেজগুলো বাংলাদেশি টাকায় ৯ লাখ টাকা থেকে শুরু হয়।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হজ যাত্রীদের খরচ বাড়ার পেছনে ডলারের মূল্য বৃদ্ধিকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন ধর্মমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান।

তিনি বলেছেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় রিয়ালের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হজের ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি। মন্ত্রী বলেন, সৌদি আরবে মক্কা ও মদিনায় অনেক এলাকায় বাড়ি ও হোটেল ভেঙে ফেলায় বাড়ি ভাড়া ব্যয় এ বছর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক নানা কারণে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় রিয়ালের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া, মিনায়-আরাফায় তাঁবু ভাড়াসহ মোয়াল্লেম ফি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে হজের ব্যয় আর কমানো সম্ভব হয়নি।

যদিও হজ এজেন্সিগুলো বলছে, হজ প্যাকেজের অতি উচ্চমূল্যের কারণে হজ গমনেচ্ছুদের অনেকের বাজেটে কুলাচ্ছে না। বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। সংসার চালাতে সাধারণ মানুষের হিমশিম অবস্থা। হজের জন্য যারা অল্প অল্প করে দীর্ঘদিন টাকা জমান তাদেরও বাজেটে টানাটানি। ফলে অনেকে হজে যেতে পারছেন না। তাদের অনেকেই হজের পরিবর্তে অল্প টাকায় ওমরাহের দিকে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া প্যাকেজের বাইরে আগের তুলনায় অনেক বেশি খরচ হচ্ছে। রিয়ালের তুলনায় টাকার মান আগের চেয়ে কমার কারণে প্যাকেজের বাইরের খরচ বেড়েছে। আগে ৪০০ রিয়াল দিয়ে কোরবানি দেয়া গেলেও এখন ৮০০ রিয়াল প্রয়োজন হচ্ছে।

হজ এজেন্সি আল নুর এয়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, মানুষ অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এজন্য অনেক সাধারণ মানুষ হজে যেতে পারছেন না। গত বছর আমাদের এজেন্সি থেকে ৩০০ জনের বেশি হজ যাত্রী পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এবার ২৬৬ জন যাত্রী নিবন্ধন করেছেন। তিনি বলেন, সৌদি সরকারের নিয়ম অনুযায়ী চলতি মৌসুমে এজেন্সিকে সর্বনিম্ন ২৫০ জন হজ যাত্রী পাঠাতেই হবে। আমরা একা ২৫০ যাত্রীর কোটা পূরণ করতে পারিনি। এজন্য অন্য এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছে। তিনি বলেন, হজ যাত্রী কমে যাওয়ায় আমরাও সমস্যায় পড়েছি। এমন ক্রাইসিস আগে কখনো হয়নি। এ বছর অনেকে টাকা ফেরত নিয়ে গেছেন বলেও জানান তিনি।

নূর-ই-মক্কা মদিনা হজ সার্ভিসের কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, হজ নিবন্ধনের সময়সীমা কয়েক দফা বৃদ্ধির পরও এবার ৩৫ শতাংশ কোটা পূরণ হয়নি। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। হজের খরচ বেড়েছে, সেই সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো না। অনেকে আমাদের কাছে এসে বলেছে, ভাই ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা ভালো না। যদি সম্ভব হয় আগামী বছর যাবো। তিনি বলেন, গত বছর আমরা ১৭২ জন হজ যাত্রী পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু চলতি বছর ১১২ জন হজ যাত্রীকে পাঠাবো। ২৫০ যাত্রীর কোটা পূরণ করতে আরেক এজেন্সির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি।

আরেক হজ এজেন্সি আবাবিল হজ গ্রুপের ম্যানেজার জামাল উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, আর্থিক সমস্যার কারণে অনেকে হজে যেতে পারছে না। অনেকে দর কষাকষি করে।

এ ছাড়া রিয়ালের তুলনায় টাকার মান কমে যাওয়ায় প্যাকেজের বাইরের খরচ বেড়েছে। বর্তমানে এক হাজার রিয়াল সমান ৩৩ হাজার টাকা। আগে এক হাজার রিয়াল সমান বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্য ছিল ২২ হাজার টাকা। এই বাড়তি খরচ হজ যাত্রীদের ঘাড়ে পড়েছে। হজ প্যাকেজের বাইরে অন্তত ১ লাখ টাকা খরচ করতে হয় বলেও জানান তিনি।

আল-নাসের এভিয়েশন সার্ভিসেস এর চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ্‌ আল-নাসের বলেন, আমাদের দেশের হাজি ৯০ শতাংশ আসে ব্রোকারের মাধ্যমে। মসজিদের মাওলানা, হাফেজ, ইমাম সাহেবদের মাধ্যমে। তারা হজ যাত্রীদের ওমরা করতে আগ্রহী করে তুলছেন। তারা বুঝিয়েছেন যে, হজ করতে অনেক খরচ, দেড় লাখ টাকায় ওমরা করে আসেন। এভাবে তারা প্রায় আড়াই থেকে ৩ লাখ মানুষকে ওমরা করিয়েছেন। এজন্য এবার কোটা পূরণ হয়নি। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকটও হজ যাত্রী কমার একটি কারণ। তবে হজের নামে ওমরা করার প্রবণতা বাড়ার কারণে হজ যাত্রী বেশি কমছে। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে কয়েকটি এজেন্সি যৌথভাবে ২৬৪টি জনকে হজে পাঠাচ্ছি। কারণ, এবার প্রতিটি এজেন্সিকে কমপক্ষে ২৫০ জন হজ যাত্রী পাঠানোর নিয়ম করা হয়েছে। কোটা পূরণ করতে যৌথভাবে পাঠানো হচ্ছে।

হজ এজেন্সি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, এ বছর জাতীয় নির্বাচনের সময় হজের নিবন্ধন কার্যক্রম ছিল। নির্বাচনকালীন সময়ে অনেকে নিবন্ধন করেনি। এ ছাড়া প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে হজের নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু এ বছর আগেই শুরু হয়েছে। মানুষের প্রস্তুতি সেভাবে ছিল না। এজন্য হজ যাত্রী কমেছে। তিনি আরও বলেন, করোনার পর অনেকে ওমরা হজ করে ফেলেছেন। মানুষ এখন ওমরায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। হজ যাত্রী কমার এটাও একটি কারণ।

https://mzamin.com/news.php?news=97712