২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৫:০১

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন এবং বাঁকবদল

-হারুন ইবনে শাহাদাত

 

শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন ছিল এই ভূ-খণ্ডে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ ইসলামী আদর্শের আলোকে একটি কল্যাণরাষ্ট্র কায়েম করা। দলটির বর্তমান অবস্থা ও বাঁকবদল দেখলে মনে হয়, অসীম আকাশে ছুটতে ছুটতে অনেক তারা যেমন হঠাৎ জ্বলে উঠে হারিয়ে যায় দলটির অবস্থা এখন সেরকম। হারিয়ে যাওয়া ওই তারকাগুলোর নামও বদলে যায়। তখন আর তাদের তারা বলা হয় না, বলা হয় উল্কা। শুধু আকাশে নয়, এই মাটির পৃথিবীতেও এমন ঘটনা ঘটে। যেমন বর্তমান আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এই দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। তিনি ও তার সাথে যারা এই রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাদের স্বপ্ন ছিল- ইসলামের সুমহান দর্শনের আলোকে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাদের সেই চিন্তার আলোকেই প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকালে ‘মূল দাবি’ নামে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন অনুষ্ঠিত পূর্বপকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলনে একটি ম্যানিফেস্টো (ঘোষণাপত্র) উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের জন্য যে কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নে শরিক হয়েছিলেন অন্য নেতারাও। তাদের প্রথম ম্যানিফেস্টোতে উল্লেখ করা হয়েছিল-

 

১. পাকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথের বাইরে একটি সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হবে।
২. পাকিস্তানের ইউনিটগুলোকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে।
৩. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর প্রতিভূ হিসেবে জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকিবে।
৪. গঠনতন্ত্র হবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান। (সূত্র : স্বাধিকার আন্দোলন ও শামসুল হক, পৃষ্ঠা-৫৮, লেখক : মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর)

শামসুল হকদের গড়া সেই রাজনৈতিক দলের নাম বদলে এখন হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বর্তমান রাজনৈতিক দর্শনের সাথেও প্রতিষ্ঠাকালীন দর্শনের কোনো মিল নেই। পুরোটাই বদলে গেছে। যদিও দলটির বর্তমান নেতারা মদিনা সনদের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা মুখে বলেন। কিন্তু তারা খেলাফত কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা শুনতেই নারাজ। কারণ তাদের বর্তমান সব প্রচেষ্টা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে রাজনীতি থেকে ইসলামকে দূরে রাখা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাতাদের সেই দর্শন থেকে যোজন যোজন দূরে চলে গেছেন। অথচ উপমহাদেশের অন্যতম মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর জাতীয় দৈনিক বণিকবার্তার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন রাজনীতিতে শামসুল হকের অবদান প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘দেশভাগের আগে ও পরের কয়েক বছর পূর্ববঙ্গে যে আন্দোলন হচ্ছিল তাতে শামসুল হক একদম প্রথম সারির শুধু নয়, প্রথম ব্যক্তি ছিলেন বলা যায়। মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা ও বুদ্ধিজীবী আবুল হাশিমের (বদরুদ্দীন উমরের বাবা) বড় প্রভাব ছিল তার ওপর। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন শামসুল হক। সে বছরই আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, দলের প্রথম ম্যানিফেস্টো তার হাতেই রচিত। ভাষা আন্দোলনের সব পর্বেই শামসুল হক ছিলেন প্রথম সারিতে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু আমতলায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিলো। তখন শামসুল হক বললেন, যেহেতু সর্বসম্মতিক্রমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সুতরাং আমিও এর সঙ্গে একমত।’

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও শামসুল হক প্রণীত ‘মূল দাবি’ পরবর্তীতে ম্যানিফেস্টোতে স্থান দেয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগের বিশ্বাসঘাতকতা, অঙ্গীকার ভঙ্গ, দুঃশাসন ও ভিন্নমতের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের জন্ম। জন্মলগ্নে, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলনে গৃহীত খসড়া ঘোষণাপত্রের মূল দাবিতে পাকিস্তানের দুই ইউনিটের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। সম্মেলনে গৃহীত ১২ দফা : ১. পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হবে জনসাধারণ। ২. রাষ্ট্রে দু’টি আঞ্চলিক ইউনিট থাকবে পূর্ব ও পশ্চিম। ৩. অঞ্চলগুলো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। প্রতিরক্ষা-বৈদেশিক সম্পর্ক ও মুদ্রাব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে থাকবে এবং অন্য সব বিষয় ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।

৪. সরকারি পদাধিকারী ব্যক্তিরা কোনো বিশেষ সুবিধা বা অধিকারভোগী হবেন না কিংবা প্রয়োজনাতিরিক্ত বেতন বা ভাতার অধিকারী হবেন না। ৫. সরকারি কর্মচারীরা সমালোচনার অধীন হবেন, কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থতার জন্য তাদের পদচ্যুত করা যাবে এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তাদের ছোটখাটো বা বড় রকমের সাজা দেয়া যাবে। আদালতে তারা কোনো বিশেষ সুবিধার অধিকারী হবেন না। কিংবা আইনের চোখে তাদের প্রতি কোনোরূপ পক্ষপাত প্রদর্শন করা হবে না। ৬. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবেন- যথা বাকস্বাধীনতা, দল গঠনের স্বাধীনতা, অবাধ গতিবিধি ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার। ৭. সব নাগরিকের যোগ্যতা অনুসারে বৃত্তি অবলম্বনের অধিকার থাকবে এবং তাদের যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হবে। ৮. সব পুরুষ ও নারীর জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। ৯. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে সব নাগরিকের যোগদানের অধিকার থাকবে। একটি বিশেষ বয়সসীমা পর্যন্ত সবার জন্য সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে এবং পূর্বপাকিস্তানের জন্য নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর ইউনিট গঠন করা হবে। ১০. মৌলিক মানবিক অধিকারসমূহ দেয়া হবে এবং কোনো অবস্থাতেই কাউকে বিনাবিচারে আটক রাখা হবে না। বিনাবিচারে কাউকে দণ্ডদান বা নিধন করা হবে না। ১১. বিনা খেসারতে জমিদারি ও অন্য সব মধ্যস্বত্ব বিলোপ করা হবে। সব আবাদযোগ্য জমি পুনর্বণ্টন করা হবে। ১২. সব জমি জাতীয়করণ করা হবে।

সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খসড়া ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ভূমি সংস্কার বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন, যৌথ খামার ও সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সব শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ, শিল্প-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ, শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং তাদের ধর্মঘটের অধিকার প্রভৃতি।
এ ছাড়া দেশের শিল্পায়ন, শিক্ষার বিস্তার ও নারীর অধিকারের কথাও প্রথম ঘোষণাপত্রে লিপিবদ্ধ ছিল।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, প্রথম ঘোষণাপত্রের ২২ দফা আশু কর্মসূচির ১৮ নম্বর দফায় আওয়ামী লীগ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং ১৯ নং দফায় ‘আগামী তিন মাসের ভেতরে জাতিসঙ্ঘ গণভোট দ্বারা কাশ্মির সমস্যার সমাধান না করলে পাকিস্তান কর্তৃক জাতিসঙ্ঘ ত্যাগ’-এর ঘোষণা দিয়েছিল।’ তিনিও তার নিবন্ধে স্বীকার করেছেন, ‘এই সম্মেলনে শামসুল হকের ১২-দফা মূল দাবি গৃহীত হয়। পরবর্তীতে খসড়া ম্যানিফেস্টো রচিত হয়।’ অবশ্য ম্যানিফেস্টোতে তখনকার বাস্তবতায় ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করার বিষয়ে নিজের মতো করে একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ম্যানিফেস্টোতে তখনকার বাস্তবতায় খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপপ্রচারের মুখ বন্ধ করার কৌশল হিসেবে। আওয়ামী লীগকে যাতে ইসলামবিরোধী, পাকিস্তানবিরোধী এবং ভারতের দালাল হিসেবে প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সে জন্য এই রক্ষণশীল ও প্রগতিবিরোধী লক্ষ্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।’ তার এই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে, খন্দকার আবদুল হামিদ ¯পষ্টভাষীর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘... তোমারই নাম আওয়ামী লীগ।’ অর্থাৎ জনগণকে ভোলাতে তারা, ‘মুখে শেখ ফরিদ ও বগলে ইট’ এই নীতি অনুসারে নজিরবিহীন।

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/801851