২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৪:৪৭

ইআরএফের মতবিনিময়

ব্যাংকিং খাত একটি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ

 

ব্যাংকিং খাত এখন একটি দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই দুষ্টচক্রের কারণে এ খাতে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থপাচার সবকিছুই ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়কালে এ মন্তব্য করেন তিনি। ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মৃধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা অনিয়ম চলছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিছু ব্যাংক বিপর্যয়ের মধ্যেও পড়েছে। আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা মার্জার করার বিষয় আগেই অনেকবার বলা হয়েছে। এ জন্য আইনি দুর্বলতা ও নিয়মনীতিগুলো ঠিক করতে হবে। কারণ ব্যাংক খাত হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। এ খাতের সমস্যা পুরো অর্থনীতির ওপরে পড়ে। তিনি বলেন, ঋণখেলাপির বিপরীতে একটি বড় অঙ্কের অর্থ ব্যাংকের প্রভিশনিং করতে হচ্ছে। এর মানে টাকাটা অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, ব্যাংকে পড়ে থাকছে। এতে করে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে আয় কমে যাচ্ছে অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানতের বিপরীতে সুদ দিচ্ছি কিন্তু ব্যাংক ঋণ দিতে পারছে ৮০ টাকা। তার মানে ঋণের সুদহার বাড়াতে হচ্ছে। এটা আবার বিনিয়োগে প্রভাব ফেলছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তিনটি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কষ্টদায়ক হলেও সংস্কার করতে হবে। তাতে অর্থনীতিতে একধরনের ভারসাম্য আসবে।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন আয়কর আইন পাস করার পাশাপাশি ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করেছে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে তাই আইন পাস বা সংশোধন করা হয়েছে, এভাবে না দেখে বরং ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর দৃষ্টিকোণ থেকে একে দেখতে হবে। আইনগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছু কিছু মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনীতিবিদের সদিচ্ছা লাগবে।

ডলারের দাম খোলাবাজারের সাথে সমন্বয় করতে হবে বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ডলারের দামের ক্ষেত্রে শক থেরাপি দিতে হবে। হয়তো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ডলারের দামে বড় ধরনের সমন্বয় করলে পণ্য আমদানি ব্যয় বাড়বে। তখন আমদানি শুল্ক কমানোর মতো আর্থিক উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও ডলারের দাম বাড়লে পণ্য রফতানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে।

মোস্তাফিজুর রহমান মূল্যস্ফীতি, পণ্য রফতানি, রাজনীতি, আসন্ন সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দেন। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত নভেম্বরে নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করার পর বাণিজ্যে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, এমন আশঙ্কায় উদ্যোক্তারা চিন্তিত। নিষেধাজ্ঞা আসার শঙ্কা রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির এই বিশেষ ফেলো বলেন, বাণিজ্যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে কি আসবে না, এলে কোন পদ্ধতিতে আসবে, সেটি অনুমান করা কঠিন। আমরা দেখেছি, শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বলতে চাই, আমাদের যেসব জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন আছে, সেগুলো যেন আমরা করি। শ্রমিকদের সাথে কথা বলে সেগুলো আমরা করতে পারি। এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, শ্রমিকেরা এক দিনে সবকিছু চাইছেন না। তাদের পাশ কাটিয়ে কিংবা সঠিক প্রতিনিধিদের সাথে কথা না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সমস্যা বাড়ে। ফলে তাদের কথা শুনে সমস্যা সমাধানে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র কী করবে না করবে, তারা জানে। নিষেধাজ্ঞা দিতেও পারে।

সরকারদলীয় প্রার্থীদের অর্থসম্পদ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রার্থীদের হলফনামা দেখে বিস্মিত, চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। এত কম সময়ে তারা এত টাকার মালিক কিভাবে হলেন, সেটি একটি প্রশ্ন। যদিও এক কোটি টাকার জমির দাম এক লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে হলফনামার থেকেও প্রকৃত সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের প্রার্থীদের সম্পদের বিশ্লেষণ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার যে প্রার্থীদের এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যৌক্তিক, অযৌক্তিক, নাকি অনৈতিক।

ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারি নিয়ে সিপিডির প্রতিবেদনে মন্ত্রীদের বক্তব্য দুঃখজনক বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে তা খুবই হতাশাজনক। আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রকৃত বিষয়বস্তুর পরিবর্তে কে এবং কারা বিষয়টি উত্থাপন করেছে তার ওপর বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

২৪ শে ডিসেম্বর প্রকাশিত সিপিডি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত বড় ২৪টি বড় কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে লুটপাটের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

সিপিডির প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সোমবার বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে তা সিপিডিকেই জানাতে হবে। ও দিকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অভিযোগ করেছেন, প্রতিবেদন তৈরিতে সিপিডি প্রকৃত গবেষণা করেনি। নির্জলা মিথ্যা।

মন্ত্রীদের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যখন কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তখন সেটাকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা না ভেবে সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। তিনি অস্বীকারের সংস্কৃতি দূর করে এবং সমস্যাটি সম্পূর্ণভাবে সমাধানের জন্য সক্রিয় উদ্যোগের পক্ষে কথা বলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সিপিডি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলেও উল্লেখ করেন মুস্তাফিজুর রহমান। (আর্থিক কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত) সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হয়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/801710