২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৪:৪৪

ব্যাংকিং সেক্টরের ৯২ হাজার কোটি টাকা কার পকেটে গেলো?

-এম এ খালেক

‘হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গা’ বলে একটি প্রবাদ আছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সম্ভবত সে কাজটিই অত্যন্ত সুকৌশলে সম্পাদন করলো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকিং খাতে যে অনিয়ম শুরু হয়েছে তার একটি সুন্দর বিবরণ তারা তুলে ধরেছেন। ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমানে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের পরও জাতীয় নির্বাচনের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার প্রাক্কালে এ ধরনের একটি সমন্বিত দুর্নীতির হিসাব জাতির সামনে তুলে ধরে সিপিডি একটি সাহসী এবং দায়িত্বশীল কাজ করেছে। সাধারণ সচেতন নাগরিকদের সবাই কম বেশি ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি এবং অনিময় সম্পর্কে অবহিত আছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সম্মিলিতভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের কি পরিমাণ টাকা লোপাট করা হয়েছে তার পরিসংখ্যান জানতেন না। সিপিডি সেই শূন্য তথ্য ভান্ডার পূর্ণ করে দিয়েছে। এ জন্য সংস্থাটি নিশ্চিতভাবেই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।

সিপিডি’র দেয়া ব্যাংক সংক্রান্ত দুর্নীতির তথ্য মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। সিপিডি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে কত টাকা ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের সংঘটিত ২৪টি ছোট-বড় দুর্নীতির মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ এবং অন্যান্যভাবে ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে তুলে নেয়া এই বিপুল পরিমাণ টাকা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশের সমান। এই অর্থ দিয়ে নিশ্চিতভাবেই বাজেট ঘাটতি মেটানো যেতো। যে অর্থ ব্যাংক থেকে লোপাট করা হয়েছে তা দিয়ে অন্তত তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। গত ১৫ বছরের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে বড় অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে গত বছর ইসলামি ব্যাংকে। ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ এর মালিক পক্ষ এস আলম শিল্পগোষ্ঠী স্বনামী-বেনামী প্রতিষ্ঠানের নামে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করিয়ে ব্যাংক থেকে বের করে নিয়ে যায়। একই প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগ সম্পর্কে আদালতে মামলা দায়ের করা মাননীয় আদালত মামলার তদন্ত কাজ আগামী জানুয়ারি মাস পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে। মামলার তদন্ত কাজ কোনো স্থগিত রাখা হলো তা আমাদের নিকট বোধগম্য হচ্ছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আলোচিত অর্থ আত্মসাৎ ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে বেসিক ব্যাংক অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। সেই সময় ব্যাংকটির পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু বিভিন্নভাবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে এ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) প্রায় ৬০টি মামলা করেছে। কিন্তু একটি মামলাতেও আব্দুল হাই বাচ্চুকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ঘটে। নানা উপায়ে এই শিল্প পরিবার সোনালী ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক থেকে প্রশান্ত কুমার হালদার, যিনি পিকে হালদার নামেই বেশি পরিচিত তিনি ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। তার দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার নির্দেশনাটি সীমান্ত এলাকায় পৌঁছে তিনি সীমান্ত পাড়ি দেবার পর। জনতা ব্যাংক থেকে এ্যানন টেক্স নামের একটি শিল্পগোষ্ঠী তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। সেই টাকা এখন আর আদায় হচ্ছে না। আগামীতে এই অর্থ ব্যাংক ফেরত পাবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে।

বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যে বিপুল পরিমাণ বের করে নেয়া হয়েছে তার সবই করা হয়েছে ঋণ গ্রহণের নামে। ঋণ মঞ্জুরির কিছু সিস্টেম আছে। একজন উদ্যোক্তা ব্যাংকে গিয়ে চাইলেই ব্যাংক তাকে ঋণ দিয়ে দেয় না। দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পর ব্যাংক যদি মনে করে যার নামে ঋণ মঞ্জুর করা হচ্ছে তার নিকট ব্যাংকের অর্থ নিরাপদ থাকবে এবং নিয়মিত কিস্তি আদায় করা যাবে তাহলেই ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করে। ঋণের অঙ্ক যদি বড় হয় তাহলে সেই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। বোর্ড ঋণ আবেদনকারীকে যোগ্য মনে করলে সেই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। খেলাপি ঋণের জন্য এ পর্যন্ত কোনো পরিচালনা বোর্ডকে অভিযুক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। অথচ বড় অঙ্কের প্রতিটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে উপস্থাপিত হয়। ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড যদি সঠিক এবং সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে তাহলে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির আশঙ্কা কম থাকে। গত ১৫ বছরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে যে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে তার সবগুলোই দলীয়করণ ও আত্মীয়করণে দুষ্ট। দলীয় আনুগত্যের কারণে এমন সব ব্যক্তিকে পরিচালনা বোর্ডে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাদের ব্যাংকিং সম্পর্কে ন্যূনতম কোেেনা অভিজ্ঞতা নেই। এসব অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা ব্যাংকে গিয়ে কর্মচারী ইউনিয়ন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অফিসার সমিতির দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে তদবির বাণিজ্য শুরু করে। আমি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে চাকরিকালীন সময় দেখেছি এক শ্রেণির পরিচালক কিভাবে ঘুষ বাণিজ্য করে। কেউ যদি তাদেও ঘুষ বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও বেশ কয়েকবার তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। একজন পরিচালক যিনি সরকারের যুগ্ম সচিব ছিলেন তিনি আমাদের ব্যাংকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগাপ্রাপ্তির পর আমাকে সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্য প্রার্থীর জন্য নির্বাচনি পোষ্টার ছাপার দায়িত্ব দেন। আমি যথারীতি পোষ্টার ছেপে দেই। তিনি সেই পোষ্টার সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য প্রার্থীকে দেন। আমি যখন সেই পরিচালককে বলি, স্যার প্রেসের বিল এসেছে ১৭ হাজার টাকা। তিনি আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বলেন এই টাকা ব্যাংক থেকে দিয়ে দেন। আমি তাকে জানাই ব্যাংক থেকে কারো ব্যক্তিগত নির্বাচনী পোষ্টার ছাপার বিল দেবার কোনো সুযোগ নেই। আমি তাকে বিল পরিশোধে বাধ্য করি। তিনি আমার উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হন। তিনি পরিচালনা বোর্ডের মিটিংয়ের এক পর্যায়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন যে আমি নাকি জামায়াত-বিএনপি’র লোক। আমাকে ব্যাংক থেকে সরাতে হবে না হলে ব্যাংকের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। তারপর আমার চেয়ে অনেক জুনিয়র একজন সাংবাদিককে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগদান করা হয়। নতুন নিয়োগাপ্রাপ্তি চুক্তি ভিত্তিক জনসংযোগ কর্মকর্তা আমার চাকরি জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেন। এক পর্যায়ে আমাকে হয়রানিমূলকভাবে বগুড়ায় বদলী করা হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে যারাই সৎ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে চান তাদেরই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। 

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালকগণ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এটা তাদের ক্ষমতার বাইরে কিন্তু এক শ্রেণির পরিচালককে দেখা যায় তারা মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ ব্যাংকে চলে আসেন বিভিন্ন কাজের তদবির নিয়ে। এমন কি কোন্ কর্মকর্তাকে কোথায় বদলী করতে হবে এমন তদবিরও তারা করে থাকেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের এক শ্রেণির পরিচালক ব্যাংকে এসে দ্বৈত শাসন কায়েম করে থাকেন। ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড যদি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে তাহলে খেলাপি ঋণের হার অনেক কমে আসবে। জনতা ব্যাংক থেকে যখন এ্যানন টেক্স নামের একটি শিল্পগোষ্ঠীকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয় এসব ঋণতো পরিচালনা বোর্ডই অনুমোদন করেছে। বোর্ডের কি একবারও মনে হয়নি একটি মাত্র শিল্পগোষ্ঠীকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি ঋণ দেয়া যায় না? এটা বিধি বহির্ভূত। সেই সময় জনতা ব্যাংকের যিনি পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি এখনো বিভিন্ন স্থানে বাগাড়ম্বর করে চলেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি কোনো তদন্তও হয়নি। তদন্ত হলে দুর্নীতির চিত্র সঠিকভাবে ফুটে উঠতো। যারা সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরের দুরবস্থার জন্য দায়ী তারা সবাই কোনো না কোনোভাবেই সরকারি ছত্রছায়ায় থাকেন। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সরকারি সমর্থনপুষ্ট দুর্নীতিবাজরা এক ধরনের দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক মামলা বিস্ময়কর গতিতে নিষ্পত্তি হলেও আর্থিক খাতের মামলাগুলো দিনের পর দিন ঝুলে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলা এখনো শেষ হচ্ছে না কেনো?

ব্যাংকিং সেক্টরে সাম্প্রতিক সময়ে যে সব বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিটির জন্য সরকারি দলের লোকেরাই দায়ী। সরকার যদি রাজনৈতিক অনুগত্যের বিচারে পরিচালক নিয়োগ না দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যাংকিং সেক্টরে নিয়োগ দিতেন তাহলে এখন এমন দুর্গতির মধ্যে পড়তে হতো না। যারা বৃহৎ ঋণ খেলাপি তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। ব্যাংকিং সেক্টর যদি কোনো কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে দেশের পুরো অর্থনীতিই ভেঙে পড়বে। তাই সতর্ক হবার এখনই সময়। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন না তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা যেতে পারে। তাদের বিদেশ ভ্রমণে বিধি নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। এছাড়া একটি নির্দিষ্ট সময় ঋণ খেলাপিদের স্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। ঋণ খেলাপিদের প্রতি কোনো ধরনের অনুকম্পা প্রদর্শন না করে তাদের মনে ভীতির সৃষ্টি করতে হবে।

 

https://www.dailysangram.info/post/544345