২১ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৫২

সরকার মানুষের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে

বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের হারার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস’র গোলটেবিল আলোচনায় দেশের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ সুষ্ঠু নির্বাচন। গত ৫২ বছরে এ পদক্ষেপই নেওয়া যায়নি। অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু রাজনীতিবিদ ও আমলারা মিলে একটি চক্র তৈরি করেছেন। এই চক্র ভাঙা ছাড়া পথ নেই। সরকার মানুষের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে বলেও মনে করে তারা আরও বলেন, ভারত, রাশিয়া ও চীন সমর্থন দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা অর্জিত আয় দিয়ে পণ্য ক্রয় করি। ইউরোপ, আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে আয় করি। এক জায়গায় আমরা খরচ করি, আরেক অঞ্চল থেকে আয় করি। স্বার্থ কোন দিকে বেশি, সেই অর্থনৈতিক অঙ্কও হিসাব করতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ: নির্বাচন, অর্থনীতি এবং বহিঃসম্পর্ক শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড. আই. খান পান্না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমান্ডার (অব) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, সিজিএস’র চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ও নিউ এইজ সম্পাদক নূরুল কবীর। এছাড়া অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে অংশ নেন সাবেক আমলা, কূটনীতিবিদ, সাবেক গবর্নর, অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নির্বাচনবিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা এবং ঢাকায় অবস্থানরত কয়েকটি দূতাবাসের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেছেন। 

সম্প্রতি নির্বাচন ঘিরে ভারতের বক্তব্য এবং পশ্চিমাদের অবস্থান উল্লেখ করে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এই মন্তব্য করে বলেন, এখানে (বাংলাদেশে) পশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে, আবার অ-পশ্চিমারাও হস্তক্ষেপ করে। এখন বলা হচ্ছে পশ্চিমারা এখানে হস্তক্ষেপ করে। ২০১৪ সালে ভারত কি এখানে হস্তক্ষেপ করেনি? করেছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিরোধী দল খোঁজার প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সিট (আসন) ভিক্ষা করার রাজনীতি চলছে। ২৬ দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তাদের ১৩টি দলের নামও কেউ বলতে পারবে না। আসন ভাগাভাগির পর সরকারি দলের ২৪০ আসন নিশ্চিত। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, কেউ কেউ বলতে চাচ্ছেন, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই অংশগ্রহণমূলক। তাহলে স্বৈরশাসকদের সময়ের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কেন? অংশগ্রহণমূলক মানে যারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করতে পারবে, সেসব দলের অংশগ্রহণ।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যে দলই এসেছে, তারা ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। ৫ শতাংশ ভোট পড়ছে, তা অন্তত ১৫ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। ভোট পড়ার যে হার, তা বিশ্বাসযোগ্য কি না। সবকিছু ঠিক থাকলেও আগামী নির্বাচনে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি হবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। এই নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতি হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনীতি আর দেশে থাকবে না। উদার গণতন্ত্রের কথা ভুলে যেতে হবে, বিশেষায়িত গণতন্ত্রে প্রবেশ করব।

আগামী নির্বাচনে সরকারি দলের হারার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবির। তিনি বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ সুষ্ঠু নির্বাচন। গত ৫২ বছরে এ পদক্ষেপই নেওয়া যায়নি। অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু রাজনীতিবিদ ও আমলারা মিলে একটি চক্র তৈরি করেছেন। এই চক্র ভাঙা ছাড়া পথ নেই। সরকার মানুষের আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে একদলীয় নির্বাচন করতে যাচ্ছে বলে মনে করেন নূরুল কবির। তিনি বলেন, ভারত, রাশিয়া ও চীন সমর্থন দিচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা অর্জিত আয় দিয়ে পণ্য ক্রয় করি। ইউরোপ, আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করে আয় করি। এক জায়গায় আমরা খরচ করি, আরেক অঞ্চল থেকে আয় করি। স্বার্থ কোন দিকে বেশি, সেই অর্থনৈতিক অঙ্কও হিসাব করতে হবে।

একটা একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ইতিমধ্যেই সিট ভাগাভাগি হয়ে গেছে। এটা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়, ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে। যার কারণে সার্বিক অর্থনীতিতেও হুমকির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ১৯৯১ সালের পরে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের মানুষেরা একবার ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ১৯৯৫ এর পরে যারা জন্মগ্রহণ করেছে তারা এখন পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। ধীরে ধীরে এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে আমাদের দেশের সবকিছু। তাই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নতুন হুমকি হিসেবে সামনে উপস্থিত হয়েছে। এখন পক্ষপাতের প্রয়োজন হলে কাদের উপর আমাদের অর্থনীতি নির্ভরশীল সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি। নির্বাচনে মনোনয়ন কেনা প্রার্থীদের প্রদর্শিত আয়ের তথ্য পুরোপুরি সত্য মনে করার অবকাশ নেই। প্রার্থীদের আসল সম্পদ আরো বেশিও হতে পারে। তবে কয়জন প্রার্থী নিয়ম মেনে ভ্যাট ট্যাক্স প্রদান করে সে বিষয়টি তদারকি করা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে ঈঙ্গিত দিয়ে সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে অথবা দুই মাসের মধ্যে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে ইত্যাদি কথা বলে জনগণকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নীতির ভুলের কারণে আজকে আমাদের অর্থনীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। আর অর্থনীতি খারাপ হওয়ার মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বলে মনে করেন তিনি। আমাদের দেশের যতটা না প্রকৃত উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে কয়েকটি সূচকের। এর ফলে যে সুফল পাওয়ার কথা ছিল তা পাচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণীর লোকেরা। তিনি আরও বলেন, গ্রামের মানুষও এখন স্যান্ডেল পরে, পার্লারে যায় এবং জিম করে। এগুলোর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গল্প শোনানো হয়। কিন্তু একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন এগুলোর মাধ্যমে চিহ্নিত করা যায় না। কিছু মানুষের আয় বেড়েছে অসমহারে। আবার কেউ কেউ কিছুই পাচ্ছে না। সুতরাং এই ভারসাম্যহীন উন্নয়ন এর কোন কাজে আসছে না। 

ঋণ খেলাপিদের সম্পর্কে সাবেক এই গভর্নর বলেন, কথায় কথায় বলতে শোনা যায় উন্নত দেশ আমেরিকাতেও দুর্নীতি হয়। আমাদের দেশে কেন হবে না। এই কথার উত্তরে তিনি বলেন ওই দেশে কেউ দুর্নীতি করলে তার বিচার হয়। সে জেলে থাকা অবস্থায় একটি ঘড়িও ব্যবহার করতে পারেনা। এমনকি সাজা কেটে বের হওয়ার পরে অনেকে আত্মহত্যা করে। কারণ তাকে সামাজিক সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে সরকার। কিন্তু আমাদের দেশে পুরোপুরি উল্টো চিত্র।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে বৈধতার সংকট দেখা দিয়েছে। এ সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা থাকলেও রাজনৈতিক বৈধতা নেই। নৈতিক বৈধতার ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া কোনটাই কাজ করছে না। সবকিছু একটি দল কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার কারণে ন্যায় ও ন্যায্যতা নেই বলে মনে করেন তিনি। বিচারব্যবস্থা সবার জন্য সমভাবে কাজ করছে না। অর্থনীতিতেও তৈরি হয়েছে বিশাল বৈষম্য। কিন্তু রাজনীতি এবং অর্থনীতি একটি অপরটির সাথে অঙ্গাভঙ্গি ভাবে জড়িত। তার সাথে বৈশ্বিক সম্পর্কও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এখন যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে থাকলে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

https://www.dailysangram.info/post/543826