২০ ডিসেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৭:১৫

গার্মেন্টসে কাটছেই না অনিশ্চয়তা

 

দেশের প্রধান রফতানি বাণিজ্য গার্মেন্টসে অনিশ্চয়তার সুরাহা হচ্ছেই না। রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই অনিশ্চয়তার আশঙ্কা বাড়ছে। সর্বশেষ গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি সমর্থন এবং শ্রম রক্ষার দাবিতে আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) কাছে চিঠি দিয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের আট সদস্য। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করে। ২৭ দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্টে বাংলাদেশকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অতঃপর গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের ‘অংশগ্রহণমূলক মডেল নির্বাচনের’ পরামর্শ উপেক্ষা করে বিএনপিকে বাইরে রেখেই ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। ফলে ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা বাড়ছে। গত ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের আট সদস্য এএএফএ’র সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী স্টিভেন ল্যামারের কাছে এই চিঠি গার্মেন্টস শিল্পের ওপর নতুন করে শঙ্কা উস্কে দিয়েছে।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশের ওপর স্যাংশন আসছে এ নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক দিন থেকেই। স্যাংশন দিচ্ছে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা। স্যাংশন বা এ ধরনের চিঠি চালাচালি আমাদের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। তবে নির্বাচনের আগে আমেরিকা কিছুই করবে না। কোনো কিছু ঘটলে নির্বাচনের পর ঘটতে পারে।

১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের আট সদস্যের এএএফএ’র সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী স্টিভেন ল্যামারকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের যে মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা দিয়ে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। এতে শ্রমিকদের প্রতিবাদ আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ সহিংস পথ বেছে নিয়েছে। এতে অন্তত চারজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য শ্রমিক আহত হয়েছেন; শ্রমিকনেতাদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে আটক করা হয়েছে; এমনকি অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবির প্রতি সমর্থন জানালেও কংগ্রেস সদস্যরা মনে করেন, শুধু কথায় কাজ হবে না। সে জন্য এএএফএ’র প্রতি তাদের আহ্বান, ১. তারা যেন শ্রমিকদের আন্দোলনে দমন-পীড়ন বন্ধ করতে তাৎক্ষণিক আহ্বান জানায়, ২. তারা যেন শ্রমিকদের ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি মেনে নিতে এবং মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়া উন্নত করতে সরকার ও মালিকপক্ষকে চাপ দেয়, ৩. তারা যেন বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্ক রাখার অঙ্গীকার করে, ২৩ হাজার টাকা মজুরি দিতে যে ব্যয় বৃদ্ধি হবে, তার পুরোটা যেন পোশাকের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ৪. তারা যেন সংগঠন করার অধিকারসহ শ্রম ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সদস্য কোম্পানিগুলোর সরবরাহব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখে। ৫. তারা যেন শ্রমিক ও ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা তুলে নিতে নির্দেশনা দেয়। ৬. তারা যেন সরবরাহকারীদের এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয় যে, শ্রমিক ও ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের ও তাদের হয়রানি করা গ্রহণযোগ্য নয় এবং সে ক্ষেত্রে পোশাক কেনার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হতে পারে, ৭. কারখানার মালিকদের ব্যক্তিগতভাবে ও শিল্পসংগঠনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে এটা নিশ্চিত করে যে, সম্প্রতি বন্ধ হওয়া কারখানার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া কংগ্রেস সদস্যদের চিঠিতে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়া যেন বাইরের কারখানাগুলোর মতো ‘অন্যায্য’ না হয়, তা নিশ্চিত করতে এএএফএকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার নীতি তথা ১৬ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমনীতি স্মারকে সই করার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বক্তৃতায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, যারা হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী বা শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে তাদের আমরা জবাবদিহি করব। নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তি, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো যতো বিষয় রয়েছে তার সবই ব্যবহার করা হবে। আমরা কল্পনা আক্তারের মতো মানুষদের সাথে থাকতে চাই। কল্পনা আক্তার একজন বাংলাদেশি গার্মেন্টসকর্মী এবং গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকারকর্মী। তিনি বলেছেন যে, তিনি জীবিত রয়েছেন কারণ মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে কাজ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওই শ্রমনীতি কার্যকরের পর গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সেখানে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

চলতি বছরের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষে ভিসানীতি ঘোষণা করে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেটাকে তোয়াক্কা করেনি। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যেতে বিএনপিসহ অর্ধ শতাধিক দলকে বাইরে রেখেই নির্বাচনের আয়োজন করেছে। ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ জো বাইডেন সরকারের প্রত্যাশা উপেক্ষা করে ‘ডামি প্রার্থী’ দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করেছে। আবার ২৭ দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্টে বাংলাদেশকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে ইইউ’র দেশগুলোতে জিএসপি বাতিল হতে পারে এমন ইংগিত প্রকাশ পেয়েছে। ফলে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। মূলত বাংলাদেশ থেকে যে পণ্য রফতানি হয় তার প্রায় ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে এবং এক তৃতীয়াংশ ইইউ দেশগুলোতে যায়। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানে রফতানি হয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিলে গার্মেন্টস শিল্প টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে আন্দোলন চলছে। সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন শ্রমিকরা মেনে নেয়নি। শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতেই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা

আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) কাছে চিঠি দিয়েছে।

দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) কর্মরত শ্রমিকদের জন্য অবশ্য খাত ভেদে ১২ হাজার ৮০০ থেকে শুরু করে ১৪ হাজার ২৫ টাকা পর্যন্ত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে ৭ ডিসেম্বর গেজেট প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। কংগ্রেস সদস্যরা মনে করেন, এএএফএ এসব বিষয় নিশ্চিত করতে প্রভাব খাটানোর মতো শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে।

চিঠিতে সবশেষে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজের দেশে যে মূল্যবোধের চর্চা করে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় তার প্রতিফলন থাকা উচিত। বাংলাদেশের শ্রমিকদের এ আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের আন্দোলনের অংশ। এক দেশের শ্রমিকদের ন্যায্যতার আন্দোলনে সমর্থন করার অর্থ হলো বিশ্বের সবখানেই তা সমর্থন করা। চিঠিতে সই করেছেন কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর, জেমস পি ম্যাকগভার্ন, জ্যান শাকোস্কি, রাউল এম গ্রিহালভা, বারবারা লি, ডেভিড জে ট্রোন, আলেক্সান্ড্রিয়া ওকাসিও-করটেজ ও সুজান ওয়াইল্ড। এদিকে এর আগে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি পেতে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্পোর্টস জায়ান্ট ব্র্যান্ড এডিডাস, মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ড লেভি স্ট্রাউস অ্যান্ড কো-এর পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যৌথভাবে চিঠি পাঠানো হয়। ঐ চিঠিতে সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে এমন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে অনুরোধ করা হয়। চিঠিতে স্বাক্ষর করা ব্র্যান্ডগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনা মহামারী পরবর্তীতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে একটি চূড়ান্ত বর্ধিত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা উচিত।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, চূড়ান্ত হওয়া মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। ৫টি গ্রেড থেকে একটি কমিয়ে ৪টি গ্রেড করা হয়েছে। একাধিক পদের শ্রমিক মজুরি কাঠামোর বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি কাঠামো নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান ইনিকলাবকে বলেন, আমি চিঠিটা পড়েছি। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিকে সমর্থন জানাতে এএএফএ’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির কংগ্রেস সদস্যরা। এটা দেশের জন্য হুমকি নয়; তারা বেতন বাড়াতে বলেছে। ইতোমধ্যে সরকার বেতন বাড়িয়েছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/625092