১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৪৩

একাত্তর ও সাতচল্লিশ এই দুই বিজয়ের তাৎপর্য

-ড. মো. নূরুল আমিন

 

গত ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় দিবস পালিত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠনগুলো এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এই দিবসের তাৎপর্য ও প্রত্যাশা প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা সভা ও টকশোর আয়োজন করেছিল। এসব সভা-সমিতি ও নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুষ্ঠানমালা এবং দর্শনীয় স্থানসমূহে মানুষের আনাগোনা ও অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে এবং নবীন-প্রবীণ সকল ধরনের লেখক-লেখিকারা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। এই দিবসে সর্বত্র মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। তবে একটি বিষয় এবার সবার হৃদয় ছুঁয়েছে বলে অনেককেই মন্তব্য করতে শোনা গেছে। প্রথমতঃ এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলো অতীতে রাত বারোটা এক মিনিটে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হত। কিন্তু এবার তা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। দ্বিতীয়তঃ বিজয় দিবসের বায়ান্নতম বার্ষিকীতে সর্বত্রই ছিল হতাশার সুর। যে স্বাধীনতা পাবার অনুপ্রেরণা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করেছিল সেই স্বাধীনতার অনুপস্থিতি, শোষণ-নির্যাতন, হত্যা-গুম, রিমান্ড, গ্রেফতার, ভোটাধিকার হরণ, গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ ও চাহিদা পূরণের প্রচণ্ড অভাব এবং দল ও গোষ্ঠীবিশেষের ক্ষমতালিপ্সা এবং আধিপত্যবাদের এজেন্ট হিসেবে নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা, একদিকে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি আর্মানিটোলায় থাকতাম। ভারত-পাকিস্তান ১৩ দিনের যুদ্ধের পর পাকিস্তান বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। ভারতীয় বাহিনী কদমতলী ঘাটে এসে নামে। তারা চকবাজার, মিটফোর্ড ও ইসলামপুর ও নবাবপুর রোড হয়ে রেসকোর্সে পৌঁছান। তাদের সাথে আমি ও আমার এক বন্ধু রেসকোর্স পর্যন্ত গিয়েছিলাম। নবাবপুর রোডে এসে ভারতীয় বাহিনীর শিখ সদস্যদের সবাই তৎকালীন ঢাকার রাস্তা ও তার আশপাশের ভবনগুলো দেখে অবাক হয়ে যান। তাদের একজন আরেকজনকে বলতে শুনেছিলাম, ‘কেয়া ভাই, ইয়ে বাঙ্গাল লোক আদমী হায় এয়া হাইওয়ান। এতনা খুবসুরত মুলক তোড় দিয়া হায়।’ অর্থাৎ এই বাঙ্গালিরা কি মানুষ না জানোয়ার। এত সুন্দর একটি দেশ তারা ভেঙে দিল? হ্যাঁ, পাকিস্তান একটি স্বাধীন দেশ ছিল। এই স্বাধীন দেশকে ভেঙে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। অনেক রক্ত ও মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। কেননা তারা আমাদের শোষণ করেছে, অধিকার বঞ্চিত করেছে। কিন্তু আজ বায়ান্ন বছর পর আমাদের হাল কী হয়েছে? আমরা বিজয় অর্জন করেছি, বিজিত কারা। এদেশের মানুষ? আমাদের স্বাধীন হবার কথা, অধিকার ফিরিয়ে পাওয়া ও বঞ্চনামুক্ত হবার কথা। আমরা কী পেয়েছি? তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালের অবস্থা দেখে অনেক বিদেশী আমাদের প্রশ্ন করতেন, তোমরা কি দেশটা জয় করেছ না স্বাধীন করেছ? একটি স্বাধীন দেশের মানুষের মনে শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ থাকে, তারা অধিকার ফিরে পায়, ইনসাফ পায়, আদালত ও আইন তাদের রক্ষাকবচ। আমরা তা পাইনি। বিজয়ী সেনাবাহিনীর ন্যায় আমাদের শাসকগোষ্ঠী আমাদের অধিকার, সম্পদ, সম্মান প্রভৃতি লুট করছে। কথা বলার অধিকার আমাদের নেই। সরকার বিরোধী লোকেরা বাড়ি-ঘরে থাকতে পারেন না। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে আমরা নিশ্চয়ই আরেকটি দেশের গোলামে পরিণত হতে পারি না। এই প্রসঙ্গে ১৯৪৭ সালে অর্জিত আমাদের প্রথম স্বাধীনতার কথা আমার মনে পড়ে। ঐ ইতিহাস আজকাল আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়ানো হয় না।

নন্দিত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ মরহুম আবুল মনসুর আহমদ জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে মন্ত্রীত্ব করেছেন, দলকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন; দল ও দলীয় নেতাদের অবিমৃশ্যকারিতার কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং চাবুক মেরে বিভ্রান্ত নেতৃত্বকে সোজা করার চেষ্টা করেছেন।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আধিপত্যবান্ধব নীতি-বৈশিষ্ট্য এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী কর্মকাণ্ডকে তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি এবং দলীয় প্লাটফর্ম ও সংবাদপত্রের কলামে যখন যেখানে সম্ভব হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ শীর্ষক পুস্তকটি আবুল মনসুর আহমদের একটি অমর কীর্তি। এই পুস্তকে সন্নিবেশিত ৪২টি প্রবন্ধের প্রত্যেকটিতে আওয়ামী রাজনীতি আমাদের স্বাধীনতাকে কিভাবে বিপন্ন করে তুলেছিল তার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। প্রচুর রক্তপাত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতাকে জনাব আবুল মনসুর আহমদ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। আর তার যে স্বাধীনতার কনসেপ্ট ছিল তা শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি পরাধীনতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা দৃষ্টিগ্রাহ্য। কিন্তু কৃষ্টিক বা সাংস্কৃতিক পরাধীনতা ধরাছোঁয়া ও দৃষ্টির ঊর্ধ্বে। তিনি বলতেন আমরা রাষ্ট্রীয় পরাধীনতার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছি। অর্থনৈতিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ কেউ সমাজবাদী হয়েছেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য আমাদের কোন চেতনার লক্ষণই দেখা যায় না, যুদ্ধ করাতো দূরের কথা। বাংলাদেশ হবার পর একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবী স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়কে অভিনন্দিত করতে গিয়ে অতি উৎসাহে বলতে শুরু করেন যে, ১৯৪৭ সালে যে মানদণ্ডের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ তথা পাকিস্তান হিন্দুস্থান হয়েছিল তা তথা দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। যারা এ ধারণায় বিশ্বাস করতেন জনাব আবুল মনসুর আহমদ তাদের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন যে তারা আসলে স্বাধীনতার বন্ধু তথা পক্ষশক্তি নয়, শত্রু। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল বলেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডকে নিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ গঠন করতে পেরেছি। যদি দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নেয়া না হয় তাহলে তার যৌক্তিক পরিণতি দাঁড়ায় অবিভক্ত ভারতের অংশ হয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে আমাদের স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্ব আর থাকে না। জনাব আবুল মনসুর আহমদ তার রচিত ‘‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’’ শীর্ষক পুস্তকে এ কথাটি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। জনাব আবুল মনসুর আহমদ ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ ইন্তিকাল করেছেন। ইতোমধ্যে গঙ্গা যমুনায় অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টির সুরাহা হয়েছে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, ভারতীয় অর্থ ও পরামর্শে পরিচালিত আঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টি পুনরায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে এবং ১৯৪৭ সালে ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের যৌক্তিকতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। সংবিধানে ৭ম সংশোধনীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এক মামলায় রায় দিতে গিয়ে একজন বিচারক ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, এ বিভাগ মানুষ মেনে নেয়নি। তিনি যখন এই রায়টি দিচ্ছিলেন তার কয়েক মাস আগে জুলাই মাসের ২২ তারিখে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার ২১টি জেলা নিয়ে হিন্দুল্যান্ড গঠনের উদ্দেশ্যে বঙ্গভূমি আন্দোলনের নেতারা বেনাপোল সীমান্তের ১০ কিলোমিটার দূরে বনগাঁওয়ে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশের তরফ থেকে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করা হয়েছিল বলে পত্র-পত্রিকায় কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। বঙ্গভূমি আন্দোলন আর ধর্মভিত্তিক ভারত বিভাজন বিরোধী প্রচারণার মূল লক্ষ্য অনুধাবন করা সম্ভবত খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। 

বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন একজন সিনিয়র মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একবার ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। এতে দেশবাসী হতবাক হয়েছিলেন। পরে তিনি আরো একটি ঘোষণা দিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ টেনে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী তিনি বলেছিলেন যে, আমরা একই দেশের একই ধর্মের এবং একই সংস্কৃতির অনুসারী। তার এই বক্তব্যে দেশের মানুষ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। কেননা ব্যক্তিগতভাবে তিনি হিন্দু অথবা মুসলমান না হতে পারেন কিন্তু এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম-সংস্কৃতি থেকে আলাদা। মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশের নেতা বা মন্ত্রী হয়ে তৌহিদপন্থী ৯০ ভাগ মুসলমানকে তিনি ভারতীয় মুশরিকদের সঙ্গে বিলীন করে দিতে পারেন না। এদেশের মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। হিন্দুরা হিন্দুদের ধর্মীয় চর্চা করুক এবং মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুক এটাই তারা চায়। জনাব আশরাফের এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি, এক দেশনীতি মেনে নিলে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর থাকে না। তাকে ভারতের সাথে এক হয়ে যেতে হয়। এ ধরনের চিন্তার মানুষ আরও রয়েছে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জনাব মতিউর রহমান নামে ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর/তদন্তকারী কর্মকর্তার একটি তথ্য আমাকে হতবাক করেছে। তিনি আমাকে দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন এবং তাকে শুধু অসার নয় মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করেছেন। পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানভুক্তির ওপর প্রশ্ন তুলে তিনি বলতে চেষ্টা করেছেন যে, চৌধুরী রহমত আলীর পাকিস্তান ফর্মুলায় পূর্ববাংলা ছিল না, তিনি বেগমগঞ্জের জয়াগে গান্ধী আশ্রমের প্রসঙ্গ টেনে রামগঞ্জের মুসলমান কর্তৃক গান্ধীর ছাগল জবাইয়ের ঘটনার উল্লেখ করে বৃহত্তর নোয়াখালী ও বর্তমান ফেনী জেলার একটি থানার (উপজেলা) নাম ছাগলনাইয়া রাখার একটি তথ্য (?) আমাকে দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে আমার নিজ জেলা বৃহত্তর নোয়াখালীর রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, রামগতি, সুধারাম, সেনবাগ, পরশুরাম প্রভৃতি উপজেলার হিন্দু নাম প্রমাণ করে যে, এসব এলাকা হিন্দু মেজরিটি ছিল। দেশ বিভাগের আগে মুসলমানরা বেশিরভাগ হিন্দুদের মেরে-কেটে এবং ভারতে তাড়িয়ে দিয়ে এলাকাকে মুসলিম মেজরিটি বানিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেছে। গান্ধী জয়াগ এসেছিলেন শান্তির দূত হয়ে। তার এই তথ্যটি শুনে ঐতিহাসিকদের কেউ যদি আত্মহত্যা করেন আমি বিস্মিত হবো না। তার কথায় আমি বিস্মিত হয়েছি এবং এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনি। যে দেশের মানুষ নিজ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানে না, বিশেষ করে যারা গুরুত্বপূর্ণ ও নীতি-নির্ধারণী পদে আছেন, সে দেশ টিকে থাকতে পারে না। এরা দেশের মানুষকে বিদেশের গোলামে পরিণত করতে পারেন।

এই স্তম্ভে প্রকাশিত আমার পূর্ববর্তী এক প্রবন্ধে আমি বলেছিলাম যে, আমাদের দেশে অনেক সময় দেখা যায় যে, আদালতের অনেক আরগুমেন্টই ব্যক্তির বিশ্বাস নিরপেক্ষ নয়। আদালতের বিচারকও মানুষ। সম্ভবত এই কারণেই রাজনৈতিক বিষয়ের রায়ে বিচারকের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও গোত্রীয় সংশ্লিষ্টতার প্রতিফলন ঘটে। এখানে পূর্ব পুরুষদের দূরদর্শিতার প্রশ্নটি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। বহুদিন আগে একটি ইংরেজি কবিতা পড়েছিলাম, লেখকের নাম আমার মনে নেই। কবিতাটির কয়েকটি চরণ ছিল এ রকম ‘We call our forefathers fool so wise we grow, our wiser sons, no doubt, would call us so.’

অর্থাৎ আমরা যতই প্রজ্ঞাবান হই ততই আমাদের পূর্ব-পুরুষদের বোকা বলি, আমাদের প্রজ্ঞাবান সন্তানরাও নিঃসন্দেহে একদিন আমাদের তাই বলবে। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইতিহাস পড়ানো হয় না। যা পড়ানো হয় তা হচ্ছে ইতিহাসের বিকৃত খণ্ডাংশ, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক কিছু কাহিনী। এ থেকে এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অতীত জানা যায় না। বৃটিশ ভারতে রাজশক্তি ও তার সহযোগী হিন্দুদের দ্বারা নিগৃহিত অনেক মুসলমানের বংশধররা এখন নিজেদের মুসলমান পরিচয় দেয়াকে অপমানকর মনে করেন। তাদের দৃষ্টিতে এই শব্দটি সাম্প্রদায়িক, যদিও হিন্দুরা নিজেদের হিন্দু হিসেবে পরিচয় দেয়ার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনও উপাদান খুঁজে পান না। অবশ্য এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেননা উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাতেই মীর জাফরের জন্ম হয়েছিল। তার বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলাই প্রথম বৃটিশ বেনিয়া শক্তির পদানত হয়েছিল। এই মীর জাফরের বংশধররা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এই বাংলার মুসলমানরা এক সময় শৌর্য-বীর্য, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে সমাজের শীর্ষে অবস্থান করতেন। বৃটিশের পদানত হয়ে তারা তাদের সকল অবস্থান থেকে বহিষ্কৃত হন এবং অর্ধশতাব্দী যেতে না যেতেই ভিস্তিওয়ালা আর কাঠুরিয়ার জাতিতে পরিণত হন।

যারা বাংলা এবং বাঙালি বলতে অজ্ঞান তাদের অনেকেই বাংলার ইতিহাস জানেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। জানলেও হীনধী এসব লোক তা স্বীকার করতে চান না। বৃটিশ শাসনামলে নানাভাবে পর্যুদস্ত ও বঞ্চিত মুসলমান প্রতিবেশী সমাজের গোলামে পরিণত হয়েছিল। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র ছিল তারা অবহেলিত। জমিদারদের শতকরা ৯৫ ভাগই ছিল হিন্দু এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিকও ছিলেন তারাই। বর্ণ হিন্দুদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে বাংলার মুসলমানরা সুশাসনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের এই দাবির প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। মুসলমানদের সুবিধাকে সামনে রেখে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা করার বৃটিশ এই সিদ্ধান্তকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথসহ ভারতের বর্ণ হিন্দুরা মেনে নিতে পারেননি। তারা এর মধ্যে মুসলিম জাগরণ ও পুনরুজ্জীবনের আভাস পান এবং অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য তারা আন্দোলন শুরু করেন। স্বদেশী আন্দোলন ছিল এই লক্ষ্যেই পরিচালিত। আরএসএস তাদের মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র বুননে স্বদেশী আন্দোলনকেই ব্যবহার করেছে। স্বদেশী আন্দোলন ও হিন্দু মহাসভার চাপে পড়েই মাত্র ছয় বছর পর ১৯১১ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ রদ করেন।

https://www.dailysangram.info/post/543600