১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৩৬

ত্রাহি দশায় নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত

 

রাজধানী ঢাকায় চোখ ধাঁধানো ফ্লাইওভার-মেট্রোরেল। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। অথচ এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান দামে মহানগরে বসবাসরত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগণের যাপিত জীবন চলছে নিদারুণ কষ্টেই। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে সংসারের খাবার জোগাতে সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। আর উপার্জনহীন মানুষের জীবন করে দিয়েছে লণ্ডভণ্ড। প্রায় প্রতি সাপ্তাহেই হু হু করে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এমন দামের কারণে একেবারেই বেসামাল সাধারণ মানুষ। তাদের ব্যয় বাড়লেও, বাড়ছে না আয়। সংসার চলাতে হাঁসফাঁস উঠছে। বাসাভাড়া বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, পানির সংকট, যানবাহণের যাতায়াত খরচ ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিম্নবিত্তদের অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।

 

বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেশি। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বেশিরভাগ সময় সিন্ডিকেটের দিকে আঙ্গুল তুলে দায় সারছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ১৪৬৩.৬০ বর্গমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখ মানুষ। নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন ঢাকায় আসা-যাওয়া করেন কয়েক লাখ মানুষ। ঢাকা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় সারাদেশের মানুষ রাজধানীমুখী। ফলে ঢাকায় বাসাভাড়া বেশ। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বেশি। কর্মজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষকে উচ্চ ভাড়ায়, বলতে গেলে বেতনের বা আয়ের সিংহভাগ টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। বাসা ভাড়ার খরচ মানুষকে অর্থনৈতিক যন্ত্রণার মুখে ফেলেছে প্রতনিয়িত। তারপরও মানুষ ঢাকায় বসবাসের চেষ্টা করে! বর্তমান সময়ে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাজধানী ঢাকার এখন প্রায় সব এলাকার বাসায় বাসায় ঝুলছে টু-লেট। ফলে অনেক বাসা ফাঁকা পড়ে আছে। মালিকরা বলছেন, বিল্ডিং নির্মাণ করতে ব্যয় বেড়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্স বেড়েছে। অথচ ভাড়াটিয়ার অভাবে বিল্ডিংয়ের একাধিক ফ্ল্যাট খালি পড়ে রয়েছে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনীয়। কারো আয় বন্ধ হয়ে গেছে, কারো কমেছে। প্রতিটি পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সমন্বয় করতে পারছেন না তারা। ফলে মানুষ ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন!

দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে গরীবের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাজধানীতে বসবাসকারী মধ্যবিত্তদের বড় অংশ ক্রমান্বয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে যাচ্ছে। বৃহত্তর উত্তরা, আরামবাগ, মালিবাগ মোড়, শান্তিনগর, আজিমপুর মোড়, সিদ্ধেশ্বরী মোড়, রামপুরা, যাত্রাবাড়ি মোড়, লোহারপুল, কমলাপুরসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মোড়ে মোড়ে ঝুলছে অসংখ্য ভাড়াবাসার বিজ্ঞপ্তি। যা আগে চোখে এমনটি চোখে পড়েনি! ঢাকার এত বাড়ি বা ফ্ল্যাট প্রায় ফাঁকা! রহস্য কী? রহস্য হচ্ছে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিম্নবিত্তও মধ্যবিত্তদের অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাসাভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪শ’ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২শ’ শতাংশ। এতে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাসাভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। অন্য এক জরিপে জানা গেছে, রাজধানীর ২৭ ভাগ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ ভাগ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ ভাগ আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসাভাড়া মানে আবাসন খাতে। মহানগরের বাসাভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিটি পণ্যের মূল্য এখন লাগামহীন। প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেশি। অথচ বেশির ভাগ কর্মজীবী মানুষের আয় কমে গেছে। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, উন্নয়নের জোয়ার বইছে চারদিকে। এই উন্নয়ন দিয়ে কী হবে, যদি মানুষ দু’বেলা দুমুঠো খেতে না পারেন, তবে এমন উন্নয়ন দিয়ে কী হবে। এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে জনসাধারণের মনে। কিন্তু যে দেশের মানুষ মৌলিক অধিকার পূরণ করতে হিমশিম খান, সেখানে উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। শ্রমজীবীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। সাধ্যের বাইরে মুরগি, গরু ও খাসির গোশত। পেঁয়াজ, আলু, ডিম, কাঁচামরিচ সবকিছুর দামই ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। জীবন ধারণের জন্য খাদ্য অত্যাবশ্যক, আবার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ পুষ্টিমানসম্পন্ন ও সুষম খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। মহামারী করোনার সময় অনেকেই চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। করোনা পরবর্তী সময় থেকেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে একসময় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ যথাযথ খাবার ক্রয় করতে পারবে না। এখনই অনেকে পারছেন না। এমন খবরও দেখা যায় তারা তাদের সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ করে দিবে। খাবার সংগ্রহ করতে না পারলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার তখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আবার খাবারের দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ থেকেও তারা পিছিয়ে থাকবে। এইভাবে মূল্যস্ফীতি গোটা দেশকে একটা বৈষম্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে সরকারের উচিত বাজার তদারকি বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি মানুষের আয়-রোজগার যাতে বৃদ্ধি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি আয়-রোজগারও বাড়ানো যায় তাহলে সংকট মোকাবিলা করা কিছুটা হলেও সহজ হবে।

রাজধানীর খুচরা বাজারে পিঁয়াজের দাম এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। খুচরায় কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যেই নতুন করে বেড়েছে আদা, রসুন, মুরগি ও ডিমের দাম। পাশাপাশি সপ্তাহের ব্যবধানে ডিম, সয়াবিন তেল, গরুর গোশত ও ছোলার দামও কিছুটা বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কাঁচাবাজারসহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চলতি সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ব্রয়লারের কেজি ছিল ১৮০ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি সোনালি মুরগি। বাজারে মুরগি বিক্রেতারা বলেন, গত সপ্তাহের ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। আগের সপ্তাহে ১৭০ টাকা করে বিক্রি করেছিলাম। চলতি সপ্তাহে ব্রয়লার ১৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।

এদিকে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আমদানি করা আদা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়, যা গত সপ্তাহেও ছিল ২৪০ টাকা। পাশাপাশি প্রতিকেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকা; যা এক সপ্তাহ আগে ২৪০ টাকা বিক্রি হয়। এছাড়া আমদানি করা রসুন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা, যা আগে ২০০ টাকা ছিল।

সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। শিম ৫০ থেকে ৭০ টাকা, ফুলকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৬০ টাকা, পাকা টমেটো প্রকারভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকা, কাঁচা টমেটো ৬০ টাকা, কচুরমুখী ৭০ টাকা এবং গাজর ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বাজারে বেগুন ৫০ থেকে ৮০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকায়, ধুন্দল ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ টাকা, শসা ৬০ থেকে ৭০ টাকা, লাউ প্রতিটি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৩০ টাকা, লেবুর হালি ২০ থেকে ৪০ টাকা, ধনেপাতা ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, কলার হালি ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর জালি কুমড়া ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, আলু ৫০ টাকা, নতুন আলু ৬০ টাকা ও কাঁচামরিচ ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে লাল শাকের আঁটি ১০ টাকা, লাউ শাক ৩০ টাকা, মুলা শাক ১০ টাকা, পালং শাক ১৫ টাকা, কলমি শাক ৮ টাকা আঁটি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। শুক্রবার এক ডজন লাল ডিম ১৩০ টাকা, হাঁসের ডিম ২০০ টাকা, দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগের সপ্তাহে লাল ডিম ১২০ টাকা ডজন বিক্রি হয়েছিল।

বাজারে মাছের দামও সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। শুক্রবার ৪০০ গ্রাম আকারের ইলিশ মাছের কেজি ৭০০ টাকা, চাষের শিং (আকারভেদে) ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, রুই (আকারভেদে) ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা, মাগুর ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা , মৃগেল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকায়, পাঙ্গাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকা, চিংড়ি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, বোয়াল ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা, কাতল ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, পোয়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, পাবদা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়, তেলাপিয়া ২২০ টাকা, কই ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়, মলা ৫০০ টাকা, বাতাসি টেংরা ৯০০ টাকা, টেংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, কাচকি ৬০০ টাকায়, পাঁচমিশালি মাছ ২২০ টাকা, রূপচাঁদা ১ হাজার টাকা, বাইম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, দেশি কই ১ হাজার টাকা, শোল ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, আইড় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং কাকিলা মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা আবু তৈয়ব। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। ঢাকায় বসবাস করছেন ২০ বছর ধরে। বেতন-ভাতা যা পেতেন তা দিয়ে অনেক কষ্টে দিন চললেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুরু হলে পড়ে যান বিপাকে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুঁজতে থাকেন কোথায়, কবে টিসিবির ট্রাক আসবে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ট্রাকের দেখা মিললে লম্বা লাইনে দাঁড়ান। পণ্য নিয়ে তৃপ্তির হাসি দিয়ে গন্তব্যে ফেরেন। কিন্তু নিম্ন আয়ের এই মানুষটির সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাটে টিসিবির পণ্যের অপেক্ষায়। এতে ব্যাঘাত ঘটছে কাজের। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে চাকরি হারানোর।

গোড়ান এলাকার বাসিন্দা নার্গিস বাসা বাড়িতে কাজ করেন। তিনি জানালেন, তারও অবস্থা করুণ। চার জনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। চাল, তেল, লবণ থেকে শুরু করে সবকিছুই কিনতে হয় তাকে। তার ওপর তার বাসাভাড়া। সব মিলিয়ে তার কষ্টের যেন সীমা নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই বাজারে নিত্যপণ্য কিনতেই চলে যায় তার আয়ের বেশিরভাগ টাকা। শত কষ্ট নিয়েই তাকে দিন কাটাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নার্গিস।

https://dailyinqilab.com/national/article/624159