১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:১২

আম্মাগো আল্লাহর ওয়াস্তে একটা সিট দেবেন...

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

 

চোখ খোলা বা বন্ধ- আমি একটা দৃশ্য দেখি। হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, দিলীপ বড়ুয়া কিংবা মে. জে. ইব্রাহিম, শমসের মবিন চৌধুরী বা তৈমূর আলম খন্দকার- এক একটি কানাভাঙ্গা ভিক্ষাপাত্র হাতে শেখ হাসিনার সামনে দাঁড়িয়ে প্যান প্যান করে বলছেন, আম্মাগো, আল্লাহর ওয়াস্তে জাতীয় সংসদে আমাকে একটি আসন দেন না। আমরা সবাই মিললে সংসদে আপনার হাত আরও শক্তিশালী হবে। আপনার ভালো হবে মা জননী।

তবে জাতীয় পার্টি তো অনেক দিন ধরে আওয়ামী লীগের লেজ ধরে জাতীয় সংসদে তথাকথিত বিরোধী দল হিসেবে আছে। কিন্তু এ বিরোধী দল সত্যি সত্যি গৃহপালিত। বিরোধী দল থেকে মন্ত্রী আছে, সরকারকে নির্লজ্জ তোষামোদ করা আছে। শুধু জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে বক্তৃতা শুরু বা শেষ করাটুকু নেই। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের গাঁটছাড়া এরশাদ গণতন্ত্র হটিয়ে সামরিক আইন জারির সময় থেকে। 

বিচারপতি সাত্তারের গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে যখন এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন, তখন সাংবাদিকরা শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কি? জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। তখনই বোঝা গিয়েছিল এই সামরিক শাসন শেখ হাসিনা না নিয়ে এলেও যেকোনোভাবেই হোক ঐ সামরিক সরকারকে তিনি বৈধতা দেবেন এবং ভবিষ্যতেও তাদের গাঁটছড়া অব্যাহত থাকবে। 

এরপর থেকেই তাদের সহযোগিতা ও সহায়তার ধারাবাহিকতা। সময় যত গিয়েছে শেখ হাসিনা ততই তার ক্ষমতা সংহত করেছেন। মেনন-ইনুসহ পতিত বাম দলগুলোও আওয়ামী লীগের প্রভাবে কিংবা নিজেদের আদর্শচ্যুতির কারণে হাসিনা তথা এরশাদের বশংবদ হয়ে পড়েন। এভাবে তারা নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলেন। এখন এসব খুচরা দু-একজন শীর্ষ নেতার নাম ছাড়া দলের আর কারও নাম কেউ জানে না। দিলীপ বড়য়ার নাম তো অনেক আগেই মুছে গেছে। এসব নিয়েই ১৪ দলীয় সরকারি জোট। শেখ হাসিনা জানেন, একটি হাড্ডি ছুড়ে দিলেই এরা কুঁই কুঁই করে ‘আওয়ামী লীগ চিরজীবী হোক’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে যাবে।

এরপর আসে জাতীয় পার্টির কথা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন নানা সুযোগ-সুবিধার লোভে কিছু লোক এরশাদের সঙ্গে জুটেছিলেন। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনে গিয়ে তিনি টের পেয়েছিলেন, দলের মধ্যে তার নিয়ন্ত্রণ অনেক শিথিল হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনে গিয়ে তিনি টের পেয়েছিলেন শেখ হাসিনার জোর-জবরদস্তির সঙ্গে তিনি পেরে উঠবেন না। পরিস্থিতি বিবেচনা করে এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তো আগেই নির্বাচন বর্জন করেছিল। এ ক্ষেত্রে যদি এরশাদও নির্বাচন থেকে সরে যায় তাহলে সে নির্বাচন যে মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না শেখ হাসিনা সেটা উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই এরশাদকে নির্বাচনে আনার জন্য তিনি ভারতের দ্বারস্থ হন। এরশাদকে বোঝানোর জন্য ভারত তাদের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকা পাঠান। এরশাদের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে সুজাতা বলেন, এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে যাবে। 

জবাবে এরশাদ বলেছিলেন, এ দায় আমার নয়। এ দায় সরকারের। তারপর এরশাদ তার দলের যারা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের চিঠি নির্বাচন কমিশনে জমা দেন। কিন্তু কোন কারণ না দেখিয়ে তৎকালীন বশংবদ নির্বাচন কমিশন প্রত্যাহারপত্রগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। অর্থাৎ সরকার সেগুলো গ্রহণ না করতে নিশ্চয়ই কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর প্রায় দুই সপ্তাহর মতো এরশাদ নিরুদ্দেশ ছিলেন। দুই সপ্তাহ পর তাকে সিএমএইচএ আবিষ্কার করা হয়। সেখানে তিনি তার কোনোরূপ অসুস্থতার খবর অস্বীকার করেন। তাতেও কোনো ফল হয় না। সরকার তার হিসেব মতো জাতীয় পার্টিরও বেশকিছু প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করে। এই হলো ইতিহাস। ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং সরকারের ছুড়ে দেয়া আসনে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে। ফলে পার্টির জনসমর্থন ও বিশ্বাসযোগ্যতায় ব্যাপক ধস নামে। এখন জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব নির্ভর করছে সরকারের দয়ার উপর।

জাতীয় পার্টির সভাপতি এরশাদের ভাই জিএম কাদের অনেকটাই ক্লিন ইমেজের লোক। চোর কিংবা নারীলোভী বলে তার কোনো দুর্নাম নেই। মাসখানেক আগে তিনি ভারত সফরে গিয়েছিলেন। কার আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন, কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কি কথা বলেছেন এ সম্পর্কে মিডিয়ায় কোনো কথা বলেননি জিএম কাদের। এখন পর্যন্ত তিনি চুপচাপই আছেন। তবে বলেছেন যে, পরিস্থিতি অনুকূল না হলে জাতীয় পার্টি লাঙ্গল নিয়ে আলাদাভাবে নির্বাচন করবে।

ইতোমধ্যে বিএনপি থেকে আগেই বহিষ্কৃত নেতা তৈমূর আলম খন্দকার ও শমসের মুবিন চৌধুরী চেষ্টা করেছিলেন আরো খুচরা দুচারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলতে। তিনি এমনও বলেছিলেন যে, তার দিকে বিএনপির শত শত নেতাকর্মী ছুটে আসবে। 

তিনি বিএনপির আগের বহিষ্কৃত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা গঠিত তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব হয়েছেন। সভাপতি হয়েছেন শমসের মুবিন চৌধুরী। তৈমূর আলমের তবু কিছুটা জনভিত্তি রয়েছে। শমসেরের কিছু নেই। ফলে এই নিধিরাম সর্দার আওয়ামী লীগ মাঠ ফাঁকা করে দিলেও জয়ী হয়ে আসতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।

তবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের বিপর্যয় এড়াতে অভিনব কৌশল গ্রহণ করেছে। বরাবর নিয়ম ছিল কেউ যদি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ায় তবে দলে তার প্রাথমিক সদস্য পদও থাকবে না। যেহেতু বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ঘোষণা করেছে এবং আন্দোলন করছে যে, এই সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। আর আওয়ামী লীগ বলেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে যাদের নমিনেশন দেওয়া হবে তাদের বাইরেও আওয়ামী লীগাররা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে। এর পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য হলো বেশিসংখ্যক ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে আসা। তাতে তার ভোটারবিহীন নির্বাচন বলা যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন বলা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ যে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৮ জনের নাম ঘোষণা করেছে, তাদের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যাবে। তেমনিভাবে ইনু-মেনন গংও হারবেন। সেই কারণে তারা বলছেন, তাদের যেসব আসনে ছাড়া দেওয়া হবে, সেসব আসন থেকে নৌকা ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শমসের মুবিন ও তৈমূর আলমের নামও কেউ নিচ্ছে না। হাসিনা যদি তার মূল প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রত্যাহার করে না নেন, তাহলে ইনু-মেননের নির্বাচনে জেতা অসম্ভব।

সুতরাং এইসব প্রার্থী এখন ভিক্ষাপাত্র হাতে কড়জোরে শেখ হাসিনার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আম্মাগো দয়া করে একটা আসন দেন না। দিলে আখেরে আপনার ভালো হবে। বড় বড় কথা বলা এইসব ব্যক্তির এমনই দশা যে, তারা নিজেদের জন্য একটা সীটও সংরক্ষণ করতে পারেননি। তাহলে আপনার ৫০-৬০ বছর ধরে যে রাজনীতি করলেন, তার ফলাফল দাঁড়াল শূন্য। তাই তাদের ভিক্ষাবৃত্তির ফলাফলও যে শূন্য হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

https://www.dailysangram.info/post/543259